রাকা দেখা পাকা দেখা

অনীক সান্যাল রাকার মৃত্যুর পর তাহাকে প্রথম দেখিয়াছিলেন নিজ শয়নকক্ষের দক্ষিণ জানালার বাহিরে প্রতিবেশী মণ্ডলদের ছাতিম বৃক্ষের তলে। রাত্রি-বেশ পরিহিতা যুবতী যেন ছাতিম-বৃক্ষের নিম্নের রসস্থ ভূমিকে আপন সুখশয্যা মনে করিয়া নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাইতেছিল। তাহার শায়িত দেহের আশেপাশে জড়ো হইয়া চিৎকার করিতেছিল শালিক পাখির ঝাঁক। ঝাঁক বলিতে গেলে সাতটি শালিক, তাহারা নিদ্রিত যুবতীর খুলি খুলিয়া মস্তিষ্কের ভিতর হইতে কুসুম্বির বীজ বাহির করিয়া ঠুকরাইয়া ঠুকরাইয়া খাইতেছিল। ত্রিশ-হস্ত দূর হইতে শয়ন-রতা রাকাকে অনীক এমনিতে চিনিতে পারিতেন কিনা সন্দেহ আছে কিন্তু যুবতী আকস্মিকভাবে আপনার দেহে এক বিকট মোচড় দিয়া সটান অনীকের দিকে ফিরিয়া খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিতেই যুবতীর পরিচয় লইয়া অনীক সান্যালের আর কোনোরূপ সংশয় রহিল না।  তিনি কি স্বপ্ন দেখিলেন, নাকি সত্যসত্যই তাহার প্রেত-দর্শন হইয়াছে! নিশ্চিত হইবার নিমিত্ত অনীক শয্যা-ত্যাগ করিয়া, আপনার চক্ষু-মর্দন করিতে করিতে পুনরায় যখন জানালার বাহিরে দৃষ্টিপাত করিলেন, ভোরের আলো-অন্ধকার-মিশ্রিত রহস্যময় পরিবেশে তিনি পুনরায় সেই চিৎকাররত শালিকের দলকে একই অবস্থায় প্রত্যক্ষ করিলেন বটে কিন্তু ছাতিম গাছের চতুর্দিক তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিয়াও তিনি আর শয়নরতা যুবতীর সন্ধান পাইলেন না। ছাতিমগাছ ছিল। বিবাদে মত্ত শালিকের ধাতব চিৎকার ছিল। ছাতিম গাছ হইতে কিছু দূরে মণ্ডলদের সদর দরজা পার হইয়া গেলে যে বিশাল খামারবাড়ি, তাহার সুউচ্চ অশ্বত্থ গাছটির উচ্চতম শাখাটি দুলাইয়া উড়িয়া যাইবার পূর্বে “থমথমমম!” বলিয়া বিকট ভৌতিক স্বরে পেচকের ইঙ্গিত-পূর্ণ সাবধান-বাণী ছিল। ঈশান কোণ হইতে দুরন্ত বেগে ছুটিয়া আসা শীতার্ত বাতাসে শুষ্ক পত্রের মর্মরধ্বনিকে ভুল করিয়া পতিপুত্রহীনা, শোকাকুলা রমণীর বক্ষ বিদারিত করিয়া দেওয়া ক্রন্দন-শব্দ মনে করিবার অবকাশ ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণ পূর্বে ছাতিম-তলে নিশ্চিন্তে শায়িত রাত্রি-বেশ পরিহিতা যুবতী-দেহের কোনোরূপ নাম-নিশান ছিল না।

রাকার সহিত অনীকের দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ হইয়াছিল মোড়গ্রাম পানাগড় সড়কের একটি বিপদজনক বাঁকে। একটি ভগ্ন-স্বাস্থ্য, মৃতপ্রায় লোকাল বাসের পশ্চাতের বাম্পার ধরিয়া সে ঘুড়ির ন্যায় উড়িতেছিল। দক্ষিণ হস্তে বাম্পার ধরিয়া, বাম হস্তে পথের প্রান্তে অনাদি অনন্তকাল হইতে দণ্ডায়মান যে ইউক্যালিপটাস আর শিশুবৃক্ষসারি, যুবতী আপনমনে উত্তাল বাতাসের সাথে তাল মিলাইয়া সেই বৃক্ষের শাখাগুলিকে স্পর্শ করিতে করিতে চলিতেছিল। দুই একবার কোনও পুষ্ট শাখার সহিত আকস্মিক সংঘর্ষে সেই মূঢ়, অঘটনপটিয়সী কিঞ্চিত দূরে ছিটকাইয়া পড়িলেও পরক্ষণেই শূন্যে ডিগবাজি খাইয়া আবার যথাস্থানে ফিরিয়া আসিতেছিল। ঘটনাটি যে বড়ই অদ্ভুত তাহাতে সন্দেহ নাই। ব্যাপারখানি ঠিক কী, দেখিবার জন্য অনীক বাইকের ব্রেকে পা দেওয়া-মাত্র তাহার হাত-খানেক দূর দিয়া একটি ব্যালেস্ট বোঝাই লরি ঝড়ের বেগে উত্তর হইতে দক্ষিণে চলিয়া গেল। শোঁশোঁ বাতাসের শব্দ আর ধূলোঝড়ের মধ্যেই অনীক চাহিয়া দেখিলেন, লরি হইতে মুখ বাহির করিয়া চালকের সহকারী তাহার উদ্দেশে উচ্চকণ্ঠে কিছু বলিয়া গেল। তাহার মুখ নিঃসৃত অমৃতভাষণ অনীক শুনিতে পাইলেন না বটে, কিন্তু তাহার অঙ্গসঞ্চালন একথা স্পষ্ট করিয়া দিয়াছিল, যে তাহা আর যাই হউক না কেন, প্রেমালাপ ছিল না। চলন্ত বাসের পশ্চাতে ঝুলন্ত,  উড়ন্ত রাকার  জন্যই তিনি মারাত্মক দুর্ঘটনার মুখে পতিত হইতে চলিয়াছিলেন, নাকি সেই উড়ন্ত রহস্যময় যুবতীর জন্যই তিনি প্রাণে বাঁচিয়া গেলেন, এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পৌঁছাতেই মৃতপ্রায় কিন্তু মরিয়া বাসটি তাহার অস্থিচর্মসার দেহখানিকে লইয়া এত দ্রুত পলায়ন করিল,অনীকতাহার দ্বিচক্রযানে সওয়ার হইয়া  আর বাসটিকে ধাওয়া করিবার অবকাশ পাইলেন না। তবে বাসটি বাঁক খাইয়া শিশু আর ইউক্যালিপটাস গাছের ভিড়ে মিলাইয়া যাওয়ার পূর্বে অনীক স্পষ্ট দেখিয়াছিলেন, উড়ন্ত যুবতীর পরিধেয় ছিল ঊর্ধ্বাঙ্গে একটি মেঘ-ধবল টপ আর নিম্নাঙ্গে আকাশ-নীল লেগিন্স।

অনীক সান্যাল শিক্ষিত ব্যক্তি। তাহার উপর শৈশব হইতেই তিনি অতিরিক্ত  ডাকাবুকো প্রকৃতির। কাজেকাজেই তিনি যে ভূতপ্রেতাদিতে বিশ্বাস করিবেন না এ কথা বলাই বাহুল্য। কিন্তুদেবস্মিতা পাল ওরফে রাকা নামক যুবতীটির মৃত্যুর কয়েক মাস পরেও ভিন্ন ভিন্ন পরিস্থিতিতে, ভিন্ন ভিন্ন বেশে অনীকের সহিত যে তাহার  বেশ কয়েকবার সাক্ষাৎ হইয়াছিল, এ কথা অনস্বীকার্য।

রাকা’র সহিত অনীকের আলাপ হইয়াছিল ফেসবুকে। যদিও অনীকের গ্রাম হইতে রাকাদের বাসস্থানের দূরত্ব বড়জোর চার পাঁচ কিমি এবং সম্প্রতি অতীতেই রাকা ওরফে দেবস্মিতা পালের জন্মভূমির আশেপাশেই অনীক সান্যালের জীবনের একটা বড় অংশ অতিবাহিত হইয়াছে কিন্তু তবুও আশ্চর্যের ব্যাপার যে তাহারা কেহ একে অপরকে সামনাসামনি দেখা দূরের কথা একে অপরের নামও কখনো শোনেন নাই। অনীক নিশিপুরের সকলের সাথে, সবকিছুর সাথে পরিচিত। বিশ্বাস বাড়ির বিখ্যাত বড় গিন্নি হইতে শুরু করিয়া রেলওয়ে ক্রসিংয়ের পার্শ্ববর্তী শূন্য স্থানটিতে চায়ের দোকান করিয়া থাকা অখ্যাত চায়ের দোকানিসহ সমস্ত মুখগুলি তাহার বড়ই পরিচিত। জনকল্যাণ সমিতির পাশ দিয়া উলাগ্রাম যাইবার সরু পথ হইতে আরম্ভ করিয়া মাহাতোদের খাবারের দোকানের কিছু দূরে অলোক প্রামাণিকের সেলুন পর্যন্ত প্রতিটি ইঞ্চি তাহার নখদর্পণে। এককালে নিশিপুরের অলিগলিতে তাণ্ডব করার সূত্রেই সেই কয়েকটি পথ আর অগুনিত মুখগুলি অনীকের স্মৃতিতে এখনো তেমনই ভাস্বর। কিন্তু কেহ যেন কোনো অজ্ঞাত উপায়ে সেই স্মৃতির ক্যানভাস হইতে  রাকা ওরফে দেবস্মিতার স্মৃতিটুকু  সযতনে ইরেজার দিয়া এমনভাবে ঘষিয়া তুলিয়া দিয়াছে, ফেসবুকের মাধ্যমে আলাপ হওয়ার পূর্বের সময়কাল তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়াও অনীক নিশিপুরের কোনো মুখ বা কোনো স্থানে রাকা নামটির অস্তিত্ব পর্যন্ত খুঁজিয়া পান নাই।

অবশ্য আলাপ হইবার পর দূরভাষে সেই চপলমতি যুবতীর বালিকা-সুলভ কলহাস্যময় আলাপচারিতায় তিনি বারংবার সেই স্বর্ণময় অতীতে প্রত্যাগমন করিয়াছেন। রাকার আলাপচারিতায় তাহার শৈশব ও কৈশোরের গল্প-গাথা শুনিতে শুনিতে অনীক অনুভব করিয়াছেন অতীতে বহু বহুবার তাহারা একই সময়ে, একই স্থানে নিজ নিজ কাজে মগ্ন ছিলেন। তিনি হয়তো যখন বৈকালিক রোদ্র মাখিতে মাখিতে খেলার মাঠে নিরুপায়, অসহায় বোলারদের নির্মম প্রহার করিতেছেন, রাকা তখন সামান্য দূরে দুর্গা-মন্দিরের সম্মুখের শূন্য স্থানটিতে সহচরীদের সহিত দৌড়াদৌড়ি করিতেছিল। কিংবা যুবক অনীক, যখন কলেজ যাওয়ার পূর্বে স্টেশনের একপ্রান্তে অব্যবহৃত পড়িয়া থাকা ওভারব্রিজে বসিয়া অন্যান্যদের সহিত রাজাউজির মারিতেছিলেন,  বালিকা রাকা হয়তো সেই ব্রিজের নিচ দিয়াই তাহার অপুষ্ট স্কন্ধে স্কুল-ব্যাগের গুরুভার লইয়া প্রাথমিক স্কুলের উদ্দেশে রওনা দিয়াছিল। অনীকের মনে হইতেছিল, অতীতে হয়তো একই বাতাস প্রথমে তাহার ঘর্ম-সিক্ত কলেবর স্পর্শ করিয়া পরে বালিকার শুচি নবতনুকে স্পর্শ করিয়াছিল। কিংবা যে ধূলিকণার উপর কিছুক্ষণ আগে চঞ্চলমতি কিশোরী আপন পদচিহ্ন রাখিয়া গলিপথে মিলাইয়া গিয়াছে, সেই ধূলিকণার উপর দর্পভরে পদার্পণ করিয়া এক অহংকারী পরিপূর্ণ যুবক সম্প্রতি অতীতের ফেলিয়া যাওয়া সমস্ত কচি পদচিহ্নগুলিকে নস্যাৎ করিয়া আপন মনে দৃশ্য হইতে দৃশ্যান্তরে চলিয়া গিয়াছে। ইহা বড়ই অদ্ভুত বটে, তাহারা একই  গ্রাম্য হাওয়া গায়ে মাখিয়াছেন। একইধরনের বৃষ্টিতে তাহাদের দুই অসমবয়সী শরীর একই সাথে আপাদমস্তক সিক্ত হইয়াছে, তথাপি কোনোদিন, কোনো কারণেই তাহারা একে অপরের সাথে পরিচিত হইতে পারেন নাই। যেন কোনো এক সর্বশক্তিমান কুচক্রী তার অদৃশ্য মন্ত্রবলে তাহাদের একে অপরকে পরিচিত হওয়ার মতো উপযুক্ত নিকটে আসিতে দেন নাই।

অবশ্য বিলম্ব হইলেও পরিচয় তো হইয়াছিল। সেদিনের প্রাণচঞ্চল কিশোরী যখন অ্যাকিউট ডিপ্রেশনে জর্জরিত যুবতী, দোর্দণ্ডপ্রতাপ লোকাল ইয়ুথ আইকন যখন ত্রিশোর্ধ ধীর-স্থির আপাত-ব্যর্থ গেরস্থ, তখন ফেসবুক নামক সামাজিক মাধ্যম তাহাদের পরিচয় করাইয়া দিয়াছিল।  এবং আশ্চর্যের ব্যাপার পরিচয়পর্বের এক বৎসরের মধ্যেই কোনো এক অজ্ঞাত কারণে দেবস্মিতার মৃত্যু হইয়াছিল। বাজারে গুজব রটিয়াছিল রাকার মৃত্যুর দিন-কয়েক পরেই নাকি অনীক সান্যালও আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করিয়া স্থানীয় হাসপাতালে ভর্তি হইয়াছিলেন। কিন্তু চার পাঁচ কিমি দূরের মফস্বলে নিজের বয়সের চাইতে তেরো চৌদ্দ বৎসরের কনিষ্ঠা অর্ধ-পরিচিত এক যুবতীর মৃত্যু কেন তাহাকে এত প্রভাবিত করিয়াছিল, তাহা লইয়া নানা মুনির নানা মত শুনিতে পাওয়া যায়। কেহ বলে,  এ সবই সস্তা, চটকদার গুজব-মাত্র, অনীক সান্যাল মত্তাবস্থায় ধারালো কাচের উপর পড়িয়া দুর্ঘটনা ঘটাইয়াছিলেন। কেহ বলে, আলাপ হওয়ার মাস-খানেকের মধ্যেই রাকা ও অনীক চরমভাবে একে অপরের প্রেমে পড়িয়াছিলেন এবং উভমুখী এই আকস্মিক দুর্ঘটনা সেই অসমবয়সী, পরিণতি-হীন প্রেমেরই ফসল-মাত্র। সে যাহাই হোক, উপযুক্ত তথ্যপ্রমাণ না থাকার কারণেই সব কয়টি রটনা’ই বাজারে আপনার নিজের গতিতে বাড়িতে লাগিয়াছিল। তবে, রাকার মৃত্যুর পরের সপ্তাহে পাশের চায়ের দোকানি ছোকরাটি প্রত্যেক রাত্রে দোকানে তালা মারিতে গিয়া প্রায় একই সময়ে একটি কালো বাইকারোহীকে উপর্যুপরি একাদশ দিবস পালদের বাটির সম্মুখের পথ হইয়া রেল-গেট পার করিয়া চলিয়া যেতে দেখিয়াছিল।

অন্যান্য ঘটনার ন্যায় এ ঘটনাও  পুরনো হইয়া তাহার উপযুক্ত গুরুত্ব হারাইয়াছে। নতুন মুখরোচক গুজব আসিয়া বৃদ্ধ পিতামাতার ন্যায় এককোণে পড়িয়া থাকা অতি পুরাতন, অনুজ্জ্বল এক গুজবকে যখন পদাঘাত করিয়া দূর করিয়া দিয়াছে।  ঠিক সেই সময়ই বেশ নাটকীয় অবস্থাতে অনীক সান্যালের তৃতীয়বার প্রেত-দর্শন ঘটিয়াছিল। পরিবারের বয়োবৃদ্ধদের উপর্যুপরি চাপে আজীবন অকৃতদার থাকার বাসনা পরিত্যাগ করিয়া অনীক সান্যাল সবান্ধব বিবাহের নিমিত্ত পাত্রী দেখিতে গিয়াছিলেন। বৃদ্ধা জননী বারবার করিয়া দিব্যি দিয়া বলিয়া দিয়াছেন, এ দেখাই যেন পাকা দেখা হয়,তা না হইলে এ বয়সে পাত্রী জোটানো দুষ্কর হইয়া পড়িবে। পাত্রীর গৃহে পৌঁছানর পর, বন্ধুরা যখন ফলমূলমিষ্টান্নাদি প্রভৃতিতে ভর্তি চিনামাটির প্লেটে মনোনিবেশ করিয়াছেন, পাত্রীর অতি বৃদ্ধা পিতামহী যখন স্থানীয় ময়রার দোকানে কেনা মিষ্টান্নাদির প্রতি ইশারা করিয়া “এসকল আমাদের টুপুরানিরই আপনার হস্তকর্মই।” বলিয়া দন্তহীন মুখবিবর প্রদর্শন করিয়া পাত্রপক্ষের বিরক্তিভাজন হইতেছেন, ঘটনাটি ঘটিয়াছিল ঠিক তাহার কিছুক্ষণ পরেই। পাত্রপক্ষের সকলকে প্লেট হইতে নিজ-হাতে ধূমায়িত চায়ের চায়ের পেয়ালা পরিবেশন করার পর টুঁপুরানি নামক শাড়ির পুঁটুলিটি যখন জড়োসড়ো হইয়া পাত্রপক্ষের সম্মুখে সুকৌশলে স্থাপিত (পাশের জানালা হইতে বৈকালিক রোদ্র আসিয়া পাত্রীকে কিঞ্চিত গৌরবর্ণা করিয়া তুলিবে এই আশায়) প্লাস্টিকের চেয়ারটিতে বসিবার উপক্রম করিতেছে, বন্ধুরা যখন “কনে দেখা” নামক একতরফা যুদ্ধের জন্য মনেমনে প্রশ্নবাণ প্রস্তুত করিয়া আক্রমণে উদ্যত,অনীক স্পষ্ট দেখিলেন, গত দশমীতে যে শাড়িটি পরিয়া রাকা মণ্ডপের এক পার্শ্বে দাঁড়াইয়া স্মৃত-মুখে সেলফি তুলিতেছিল, সেই শাড়িটি পরিয়াই সে চেয়ারের ঠিক পশ্চাতে নিশ্চল দাঁড়াইয়া আছে। অনীক ভয় পাইলেন কিন্তুরাকা তাহার ভীতসন্ত্রস্ত চেহেরা দেখিয়া পাছে ভবিষ্যত কোনও দুষ্টকর্মে অনুপ্রাণিত হয়, ভাবিয়া, দেখিয়াও না দেখার ভান করিয়া উপরের দিকে তাকাইয়া কড়িকাঠ গুনিতে লাগিলেন। কিয়তক্ষণ এরূপে অতিবাহিত হইল কে জানে! হঠাৎ সমস্বরে “গেল গেল” চিৎকার শুনিয়া সম্মুখেই দৃষ্টিপাত করিতেই, দেখিলেন, পাত্রী-বেশে সজ্জিত শাড়ির পুঁটুলিটি কুমড়োর ন্যায় মাটিতে গড়াগড়ি খাইতেছে। আর তাহার হাত-খানেক দূরে ছিটকাইয়া পড়িয়া থাকা প্লাস্টিকের চেয়ারখানির অদূরে দাঁড়াইয়া রাকা জীবিত অবস্থায় যেমন গা দুলাইয়া হাসিত, অবিকল একই-ভাবে তুমুল হাসিতেছে। পাত্রীর পিতা আসিয়া, বয়স হইল বটে কিন্তু তোমাদের জ্ঞানগম্যি আর হইল না।“ বলিয়া অনির্দিষ্টকে বিদ্রূপ করিয়া, শেষমেশ প্লাস্টিকের চেয়ারের পরিবর্তে একখানি শীতলপাটি বিছাইয়া দিয়া,  পূজার ঘটের উপর কদলী স্থাপনের ন্যায় তাহার উপর টুঁপুরানিকে অধিষ্ঠিত করিয়া পরিস্থিতি সামাল দিলেন বটে,কিন্তু ততক্ষণে যা সর্বনাশ হইবার হইয়া গিয়াছে। সমবেত প্রমীলাকণ্ঠের গুনগুনানি থামিয়া গিয়াছে। বন্ধুরা এতক্ষণ অনীকের সহিত টুঁপুরানির বয়সের পার্থক্য লইয়া নিচুস্বরে যে আপাত-অশ্লীল রসালাপ করিতেছিল, তাহাও বন্ধ। কিছুক্ষণ আগে নারী পুরুষের ভিড়ে, রঙ্গরসিকতায়, হৈহুল্লোড়ে যে উৎসবমুখর আবহের সৃষ্টি হইয়াছিল, হঠাত সেখানে অস্বস্তিকর শ্মশানের নীরবতা আসিয়া বিরাজ করিল।

পাত্রীর পিতাই প্রথম নীরবতা-ভঙ্গ করিলেন। অনীকের দিকে চাহিয়া, “আমি বলিতেছিলাম কী, হেঁহেঁ, মানে আপনাদের যদি কিছু জিজ্ঞাস্য থাকে, তাহা হইলে স্বচ্ছন্দে করিতে পারেন। মানে, ঐ বলিতেছিলাম কী, কনে দেখিবার কাজ…..“ তাহার কণ্ঠ হইতে যুগপৎ কন্যার পিতাসুলভ কৃত্তিম বিনয় এবং এইরূপ বিনীত ভাষণ হইতে সৃষ্ট গ্রাম্য গৃহস্থসুলভ অস্বস্তি ঝরিয়া পড়িল।

“কনে দেখিবার” দায়িত্ব বন্ধুদের স্কন্ধেই আরোপিত ছিল। তাহারা, “পঠনপাঠন কতদূর?”  “জন্মসাল কত?”, “বিয়ে কি নিজের ইচ্ছায়, নাকি পিতামাতা কোনোরূপ জোরজবরদস্তি করিতেছে?“প্রভৃতি নানাবিধ জটিল হইতে জটিলতর প্রশ্নের অস্ত্রশস্ত্র সাজাইয়া প্রস্তুত হইয়া অনীকের ইশারার অপেক্ষায় বসিয়াছিল। ভাবখানা এমন যেন সেনাপতির আদেশ পাইলেই মহা-পরাক্রমে শত্রুর উপর ঝাঁপাইয়া পড়িয়া তাহাকে তৎক্ষণাৎ ছত্রভঙ্গ করিয়া দিবে। কিন্তু অনীকের দৃষ্টি যেন এইসব পার্থিব দায়দায়িত্ব হইতে বহুদূরে নিবিদ্ধ ছিল। সে টুঁপুরানির মাথার উপরে খোলা জানালা দিয়া অনুপ্রবেশকারী একটি মাছির আগমনপথের দিকে নিবিষ্টচিত্তে চাহিয়া কী যেন দেখিতেছিল। অনীক ব্যতীত কেহই লক্ষ্য করেন নাই, কিছুক্ষন আগে এই পতঙ্গটিই বাহির হইয়া প্রথমে বারান্দার এককোণে পতিত এঁটো পেয়ালার প্রতি মনোযোগী হইয়াছিল। অনীকওতখন খানিক নিশ্চিন্ত হইয়াছিল বটে কিন্তু পুনরায় তাহার প্রত্যাবর্তন অনীককে আবার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করিয়া তুলিল। কিছুক্ষণ আগেই যে অনীক সান্যাল আপনার কর্মে মনোনিবেশ করিতে হইবে বলিয়া নিজেকে প্রবোধ দিতেছিলেন, সেই অনীক সান্যালই আবার সেই বেহায়া পতঙ্গের অনুপ্রবেশের ফলে কেমন যেন অস্থির হইয়া উঠিলেন। অবোধ পতঙ্গ প্রথমে আসিয়া অনীকের গালে বসিল। নাকে বসিল। তারপর এক অদ্ভুত মিহিন গুঞ্জন তুলিয়া অনীকের চতুর্দিকেচক্রাকারে পাক খাইতে লাগিল। অনীক সযতনে মৃদুভাবে যতবার সেই বেহায়া পতঙ্গটিকে সরাইতে যান, সে দুষ্ট ততবার খানিক সরিয়া গিয়া আবার ফিরিয়া আসা। কনের হস্তাক্ষর পরীক্ষার নিমিত্ত যে দিস্তা খাতাখানি আগাম প্রস্তুত করিয়া রাখা ছিল, বেগতিক দেখিয়া একজন অতি শুষ্ক চেহারার শ্যালক-সম্বন্ধী গোছের ব্যক্তি সেই খাতাটি তুলিয়া গুঞ্জন লক্ষ্য করিয়া সজোরে আঘাত করিবার চেষ্টা করিতেই অনীক অস্বাভাবিক জোরে “আঃ! কী হচ্ছে, আশ্চর্য! লাগবে তো!” বলিয়া এমন উচ্চকণ্ঠে চিৎকার করিয়া উঠিলেন, এঁটোকাঁটার লোভে উঠানে অপেক্ষারত গৃহস্থের পালিত কুকুরটিও ভয় পাইয়া সবেগে পলায়ন করিল। গৃহমধ্যে যারা উপস্থিত ছিলেন তাহারাও যে মারাত্মক্রকমের ভয় পাইয়া গিয়াছিলেন, তাহা বলাই বাহুল্য! শুঁটকো লোক, “না মানে আপনাকে জ্বালাতন করিতেছিল বলিয়াই….  ঐ আর কী… আপনাকে তো লাগিত না…” বলিয়া কিন্তুকিন্তু করিয়া হাত কচলাইতে লাগিল। পাত্রীপক্ষের লোকজন রীতিমতো বিরক্ত, বন্ধুরাও অপ্রস্তুত। কিন্তু অনীককে এইসব ঘটনা দৃশ্যতই স্পর্শ করিতেছিল না। সে চাহিয়া দেখিতেছিল, সম্মুখের শীতলপাটিতে জড়োসড়ো, ভীত বসিয়া থাকা শাড়ির পুঁটুলিটির পাশে রাকা অভিমানী, অবোধ বালিকার ন্যায় আপন ওষ্ঠাধর স্ফুরিত করিয়া বসিয়া আছে।তাহার চক্ষু হইতে বিন্দুবিন্দু নীল অশ্রু শীতলপাটির উপর ঝরিয়া পড়িতেছে। সেই নিমগামী নীলবর্ণের অশ্রুফোঁটাগুলির পতনের পর শীতলপাটি ভেদ করিয়া, মাটি ভেদ করিয়া পাতালে প্রবেশের দৃশ্য হইতে দৃষ্টী সরাইয়া, অনীক ফিসফিস করিয়া রাকাকে প্রবোধ দিতে লাগিলেন, “ পাত্রী দেখিতে আসিলেই বিবাহ হইয়া যাইবে কি?” তারপর দুষ্ট সন্তান যেমন অবিভাবকের অজ্ঞাতে কেবলমাত্র ইঙ্গিতের দ্বারাই আপন দুষ্ট পরিকল্পনার বার্তা দুস্কর্মের সঙ্গী বা সঙ্গিনীটিকে পৌঁছাইয়া তেমন মুখভঙ্গি করিয়া চোখ মটকাইয়া পরিস্থিতিকে লঘু করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। রাকা ম্লান হাসিয়া, মাথা নাড়াইয়া আপন মুষ্টি খুলিয়া দেখাইল। অনীক চমকাইয়া দেখিলেন, যুবতীর মুষ্টিতে ধরা একাধিক সাইটোলাপ্রামের র‍্যাপার। অনীক তাহার মুখের দিকে চাহিতেই রাকা ইশারায় বোঝাইল, সবগুলোই ইতিমধ্যেই সে গলাধঃকরণ করিয়াছে।  “এত অধিক পরিমাণে অ্যান্টি ডিপ্রেশন্ট একসাথে! আর য়্যু নাটস?” অনীক যথাসম্ভব নিম্নস্বরে রাকার পানে তাকাইয়া তাহাকে ধমক দিল। রাকা পুনরায় তাহার ওষ্ঠাধর স্ফুরিত করিয়া কাঁদিতে বসিবে ভাবিয়া অনীক তাহাকে ভুলাইবার নিমিত্ত জন্যে মনেমনে প্রস্তুত হইতেছিল। কিন্তু কোথায় কী! রাকা অনীককে কোনো সুযোগ না দিয়াই আপনার মুখগহ্বর হইতে একটি চকচকে ব্লেড বাহির করিয়া আপনার দক্ষিণ হস্তের দ্বারা আপন বাম হস্তের কব্জির উপর  উপর্যুপরি আঘাত করিতে লাগিল। বৈকালিক মৃতপ্রায় রোদ্রেও নতুন ব্লেডের ধার ঝকঝক করিয়া অনীকের চোখ ধাঁধাঁইয়া দিল। অনীক,  “আঃ, ব্লেড, কাটিয়া যাইবে তো, রাখিয়া দে, কী পাগলামি!” একসাথে এত কথা বলিতে গিয়া কিছুই বলিতে পারিলেন না। তাহার কণ্ঠ হইতে শুধু দানবিক ঘড়ঘড় ধ্বনি নির্গত হইতে লাগিল। তাহার চক্ষু ভয়ানক রঞ্জিত হইয়া উঠিলে, তাহার মুখ হইতে বমনের ন্যায় লালার প্রপাত দরদর করিয়া তাহার শখের দামি টি শার্টটিকে সিক্ত করিয়া দিলে, পাত্রী-বেশে সজ্জিত শাড়ির পুঁটুলি সভয়ে আর্ত-চিৎকার করিয়া গৃহের একপ্রান্তে সরিয়া গেল। অনীক দেখিল, রক্তের ছিটা জানালার গোবরাটে ড্রপ খাইয়া পাশের বাড়ির শ্যাওলাধরা পাকা দেওয়ালের উপর শায়িত মাধবীলতার ঝোপের উপরে গিয়া আছড়াইয়া পড়িয়া ফুলগুলিকে আরো রক্তবর্ণ করিয়া তুলিল। আশেপাশের দেওয়ালেও যে রক্তের ছিটে লাগিল না এমন নহে। কিন্তু তাহা পূর্বের চাইতেই অনুজ্জ্বল। রাকা তাহার বাম হস্ত অনীকের চক্ষুর সম্মুখে আসিয়া তুলিয়া ধরিতেই, অনীক দেখিল, দু তিন ইঞ্চি স্থানে এত বেশিবার ব্লেডের আঘাত করা হইয়াছে, যে হাত উপুড় করিতে না করিতেই শিরা ও মাংসের কুটিগুলি ঝরঝর করিয়া মেঝের উপর ঝরিয়া পড়িল। সেই রক্ত-লাল মাংসের টুকরাগুলিকে সযত্নে কুড়াইয়া পকেটে রাখিতে রাখিতে অনীকের সুদূর শৈশবে প্রাতঃকালে মাতুলালয়ের উঠান হইতে শিউলি কুড়ানোর  কথা মনে পড়িয়া গেল।

হঠাৎ গৃহস্বামী তাহার নারীসুলভ কণ্ঠস্বরকে যথাসাধ্য পুরুষালি করিয়া গৃহকর্তীকে আদেশ দিলেন, ” টুঁপুর মা,  টুঁপুকে নিয়ে ও ঘরে যাও। তারপর বন্ধুদের দিকে দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন, “আপনারাও আপনাদের বন্ধুকে নিয়ে এখন আসতে পারেন। আমি ঠিক করেছি, এখনই আমার মেয়ের বিয়ে দেব না। আর শুনুন, অন্য কোনো মেয়েকে দেখতে যাওয়ার আগে পারলে বন্ধুকে কোনো ডাক্তার দেখিয়ে নেবেন।”

বন্ধুদের মুখ রাগে, অপমানে কালো হইয়া গেল। তাহারা অনীককে টানিতে টানিতে অপেক্ষমাণ টাটা সুমোর দিকে লইয়া যাইতে লাগিল। অনীক চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিয়া রাকাকে খুঁজিতেছিলেন। জানালায় রাকা নাই। সামনের বারান্দায় যেখানে লক্ষ্মী আর মাধুরী দীক্ষিতের ক্যালেন্ডার হাওয়ায় দুলিয়া দুলিয়া ছোঁয়াছুঁয়ি খেলিতেছিল,  সেখানেও রাকা নাই। তুলসী মন্দিরের পাশে, আলকাতরার প্রলেপ দেওয়া লোহার দরজার পাশে, হাজার খুঁজিয়াও তিনি আর রাকার দেখা পাইলেন না। পেছন হইতে কে যেন বলিল, “পাগলের বিয়ে দিতে এসেছে! এসব লোকেদের ধরে জেলে দেওয়া উচিৎ!” কোনো এক মেয়েলি হায়হায় করিয়া উঠিল, “এত যে রান্নাবান্না করলাম, সব নষ্ট….”

বন্ধুরা অনীককে গাড়িতে তুলিয়া দিয়া বিস্মিত, হতোদ্যম এবং যারপরনাই হতাশ হইয়া “অদ্ভুত! ” বলিয়া ধূমপানে ব্যস্ত হইয়া পড়িল। কেহ আর লক্ষ্য করিল না, গাড়ীর পশ্চাতে বসিয়া অনীক বিড়বিড় করিতেছিল, “অদ্ভুতই বটে! মেয়েটা সত্যিই বড় অদ্ভুত!”

মিনিট পনেরো পরেই ভাড়ার গাড়ি মোরাম রাস্তা অতিক্রম করিয়া পাকা পিচের রাস্তায় আসিয়া উঠিল। রাস্তার ডানদিক হইতে গন্ধরাজ কিংবা চারচোখো কিংবা ঐ জাতীয় কোন এক এক মনোরম পুষ্পগন্ধ আসিয়া খোলা জানালার ভিতর দিয়া অভ্যন্তরে প্রবেশ করিয়া সিগারেটের কটু-গন্ধের সাথে মিশিয়া গেল।  অনীক চাহিয়া দেখিলেন, বাঃ! কাহারা যেন প্রায়  বিঘা খানিক জমির উপর একখানি অতিসুন্দর শখের বাগান করিয়াছেন। আহা! যেদিকে দুচোখ যায় কেবল পুষ্প আর পুষ্প।অনীক রক্তবর্ণ গোলাপ দেখিলেন। রজনীগন্ধা।  জবা। একটু পূর্বদিকে ঘেঁষিয়া অসংখ্য গাঁদাফুল ফুটিয়া আছে। বেড়ার দিকে নাম না জানা অসংখ্য-রকমের পাতাবাহারের গাছ। গাড়ি দ্রুত চলিতেছিল বলিয়াই বাগান ক্রমশ দূর থেকে দূরবর্তী হইতেছিল। অনীক নজর ফিরাইয়া রাস্তার দিকে দৃষ্টিপাত করিতে যাবেন, এমন সময় রাকাকে তিনি চতুর্থবারের মত দেখিলেন।  সে অভিমানিনী এখন আলোছায়া-মাখা দূরবর্তী এক কোনায় আলগা মাটির উপর দাঁড়াইয়া ঝরিয়া পড়া কাঠমল্লিকা পুষ্পগুলিকে আপন খোঁপায় গুঁজিতেছিল। অনীকের চোখে চোখ পড়িতেই সে যুবতী স্মৃত হাসি হাসিয়া চোখ মটকাইয়া, অনীকের উদ্দেশে হাত নাড়াইল। অনীকও তাহার দিকে হাত নাড়াইয়া, আপনমনে হাসিতে-হাসিতে অস্ফুটে বলিল, ” শয়তান!’

Facebook Comments


Tags :