মীরাবাঈ

বাসটা ঢাকুরিয়া ব্রিজ ক্রস করছে, ঠিক এমন সময়ে আধ সেকেন্ডের জন্য শুভদীপের মনে হয়েছিল কাজটা হয়তো সে ঠিক করছে না। এতদিন বাদে কৃষ্ণার বাড়ি হঠাৎ গিয়ে পড়া… কিন্তু ঘড়িতে সেকেন্ডের কাঁটা একঘর পেরনোর আগেই মাথা থেকে সে চিন্তা উবে গেল। কৃষ্ণা কী করবে? রাগ বা অভিমান? সেসব নিপুণ দক্ষতায় ম্যানেজ করতে কী বহুকাল আগেই শিখে যায়নি সে? শুভদীপ নাগ কলকাতার থিয়েটারের দুনিয়ার একজন ‘ডায়নামিক’ অভিনেতাই নয় শুধু। সে আসলে একজন অতি দক্ষ ম্যানিপুলেটর, যদিও এই একটা কথা তার সম্বন্ধে সে নিজে ছাড়া আর কেউই জানে না। কৃষ্ণার সাথে কমিট না করেও অতদিন জড়িয়ে থাকা যে সে লোকের কাজ ছিল না, বিশেষত যখন তিরিশ ছুঁইছুঁই একটা মেয়ে বিয়ে করতে নিতান্তই আগ্রহী হয়ে পড়েছে। কৃষ্ণা অত্যন্ত ফেরোশাস, ইন্ডিপেন্ডেন্ট, এবং খান্ডারনি প্রকৃতির মেয়ে ছিল সে আর কে না জানে। ঐ মেয়ে কারো প্রেমে পড়ে এতটাই গদগদ হয়ে পড়বে যে তার কাছ থেকে কোনোরকম আশ্বাস না পেয়েও একনিষ্ঠ মীরাবাঈ হয়ে পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করবে, এটাও ন্যাচারেলি কেউ ভাবতেই পারেনি।
কিন্তু শুভদীপ ভাবতে পেরেছিল। বুঝতে পেরেছিল, ঠিক ঠিক কী কী বললে কৃষ্ণার নারকোলের মত হৃদয় পুজোর আগে পুরুত যেমন ভাঙে তেমনই এক আছাড়ে ভাঙা যাবে। সে জানত, কৃষ্ণা তাকে প্রস্তাব দেবেই। সে বন্ধুত্বে ঠিক তত পরিমাণ সহানুভূতি এবং মায়া মিশিয়ে রেখেছে যতটা হলে মনের আস্তরণে চিড় ধরে। কিন্তু আগ্রহ দেখায়নি এক ফোঁটাও। ট্রাম থেকে নামার সময়ে বাড়িয়ে দেওয়া হাতটা নামার পরেই ছেড়ে দিয়েছিল, কোয়ার্টার সেকেন্ডও দেরী করেনি। বরং চোখ ব্যবহার করেছে। হাসি। কৌতুহল সেই অব্যর্থ ফাঁদ, এও শুভদীপ জানে। জানে, কন্ট্রাডিকশন কৌতুহল তৈরী করে। সঙ্গে এও জানে, যে নিজের হার্টব্রেকের একটা হাতে গরম গল্প অল্প অল্প করে রেগুলারলি সার্ভ করলে নারীহৃদয় রেসপন্ড করবেই। প্রথম গার্লফ্রেন্ড ডিচ করার পর থেকে একা ঘরে বন্ধ হয়ে প্রতিদিন এসব নিয়েই ভেবেছে সে। কীভাবে মানুষ প্রেমে পড়ে? কেমিস্ট্রিটা কী? একটা অংক আছে নিশ্চয়ই। সেই ফর্মুলাটা পেয়ে গেলেই তো জীবন খুব সহজ হয়ে যাবে… নলেজ ইজ পাওয়ার। দীর্ঘদিনের অ্যাকাডেমিক অভ্যেসে একটা স্ট্রাকচার খাড়া করে ফেলতেও অসুবিধে হয়নি। অতএব, কৃষ্ণা যে প্রস্তাব দেবেই, তাও শুভদীপ জানত। কৃষ্ণা তাকে প্রস্তাব দেওয়ায় সে তাই অত্যন্ত ভেবেচিন্তেই বলেছিল, ‘এই মূহুর্তে তোমার প্রতি আমার প্রেম নেই, তুমি আমার ভীষণ ভালো বন্ধু। পরে কী হবে তা অবশ্য বলা যায় না।‘ এটাই, ঠিক এটাই। একটি বাক্যের মধ্যে ‘না’ এবং ‘হ্যাঁ’ কীভাবে সমপরিমাণে মিশিয়ে দেওয়া যায় সেটা শুভদীপ নাগ জানে। আর বাকি গাড়লগুলো জানে না বলেই ফ্যা ফ্যা করে ঘুরে বেড়ায়। পরিমিতিবোধ। ওইটাই সব। একটা কনফিউশন তৈরী করা, এবং তা জিইয়ে রাখা। এইটুকুই লাগে, এরকম একটা লং-টার্ম মীরাবাঈ গড়ে তুলতে।
নাহ, কৃষ্ণাকে সে বিয়ে করেনি। অতি গোক্ষুরী হত সেটা। বিয়েটা সে সতর্ক হয়ে করেছে। কৃষ্ণার মত মেয়েকে বিয়ে করা অসতর্কতা হত। খানিক মাথা খারাপ তো বটেই, সাথে প্রচুর এক্সেন্ট্রিসিটি, রোম্যান্টিক ন্যাকামি, প্লাস একগুঁয়ে… সব মিলিয়ে ডেঞ্জারাস প্যাকেজ। প্রথামতে প্রেম করাও খুব রিস্কি হত। প্রেম ভাঙলে নিজের সমস্ত গুপ্তকথা অন্যকে বলে বেড়াত, পরের প্রেমিককে, অফ কোর্স, আর এই করতে গিয়ে নিজেই বেখেয়ালে প্রেমে-ফেমে পড়ে গেলে সে আরেক চিত্তির হত। না ভাই, শুভদীপ এইসব জানে। দুনিয়ায় সব জিনিসেরই একটা ফর্মুলা আছে। কিছু কিছু মেয়েদের প্রেমিকা-কাটিং দেখতে, আর কিছু কিছু মেয়েদের বন্ধু-কাটিং। বন্ধু, অর্থাৎ ইমোশনাল কুশন। প্রেমিকা, অর্থাৎ ভাবী বৌ। এসব গুলিয়ে ফেললে চলে না। তার ওপর এই মেয়ের আবার বাজারে খুব সুনাম নেই। আগে একটা বিবাহিত লোকের সাথে দীর্ঘ সম্পর্ক ছিল। আর কার কার সাথে যে শুয়েছে, তাই বা কে জানে? নানাজনে নানা কথা বলে। কে জানে, হয়তো এসব কারণেই কৃষ্ণার বাবা অত করে বাড়িতে ডেকে আপ্যায়ণ করে খাওয়াতেন। পাওয়া গেছে একটা রেডিমেড জামাই, এর গলায় এবার ঝুলিয়ে দেওয়া যাবে, এই ভেবে। এই ফাঁদে শুভদীপের মত ব্রাইট ছেলে ল্যাবার মত পা দিলে বন্ধুদের কাছে মুখ দেখানো যেত?
কৃষ্ণা তার মীরাবাঈ। তার নিজের মনে মুচকি হাসার ছুতো। আর গল্পগাছার রসদ। নিজের বৌয়ের কাছে যে আজ এতখানি ফুটেজ পেয়ে থাকে, তা কী এমনিই? একজন শিক্ষিত, মোটামুটি ভালো দেখতে মেয়ে কেমন করে তার প্রেমে পাগল হয়ে ঘুমের ওষুধ গিলতে গেছিল, কেমন করে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল শরীরের খিদে মেটাতে, অথচ সে অনড় থেকেছে নিজের সংকল্পে… নিজের ‘না’টুকুতে… এটা এমন একটা হিরোইক গল্প যা যে কোনো মেয়েকে খানিক নাড়া দেবেই। এ ছেলে প্রেম ব্যাপারটাকে সিরিয়াসলি নেয় তাহলে! – এটা ভাবতে বাধ্য। আজকাল ক’জনকে পাওয়া যায়, এমন? শুভদীপ একবার বিড়বিড় করে ওঠে… “Truth is stranger than fiction… but fiction is stronger than truth…” ঠোঁটে আলতো ছুঁয়ে যায় হাসির রেশ। নিজেরই নিজের পিঠ চাপড়ে দিতে ইচ্ছে করে…। ধুর, আজকালকার ছোকরারা স্ক্রিনশট দিতে শিখেছে। গল্প বলতে কেউ শিখল না।
এইসব ভাবতে ভাবতেই বাসটা এইটবি চলে এসেছে। শুভদীপের হঠাৎ খেয়াল হল, একজন মারকাটারি সুন্দরী তার পাশে বসে আছে। দেখেছ, আলবাল ভাবতে ভাবতে এই ব্যাপারটা খেয়ালই করেনি। ব্যাপার হল, ঝাড়িফাড়ি শুভদীপ মারে না। সে নিজেকে একজন ভালো ছেলে বলেই মনে করে। কিন্তু সুন্দরী মেয়েদের সাথে আলাপটা সেরে রাখাই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে করে। সৌন্দর্য্য একটা ক্ষমতা, আর সুন্দরীমাত্রেই অধিকাংশ ক্ষেত্রে হয় নিজে খুব ইন্টারেস্টিং হয়, আর নয়তো ইন্টারেস্টিং লোকজনকে চেনে। সুন্দরীদের সাথে আলাপ থাকা ভালো ব্যাপার। কখন কী কাজে লেগে যায় কেউ জানে না। বিড়বিড় থামিয়ে গুনগুনে পা বাড়ালো শুভদীপ, অতএব। সে নিজেও বেশ সুপুরুষ, গানের গলাও মন্দ নয়। এখনো গড়িয়া অবধি সময় আছে তার। এবং মেয়েটি আড়চোখে তাকাচ্ছে অলরেডি… সুতরাং… অভি না যাও ছোড়কর… কে দিল অভি ভরা নেহি…
বাহ, গানের গলাটা তো বেশ আপনার?
এর উত্তরে যে কোনো গাড়ল গান থামিয়ে সিধে দাঁত কেলিয়ে উত্তর দিতে যেত। কিন্তু শুভদীপ নাগ যে কোনো গাড়ল নয়। তাই সে পরের দু’লাইন সামান্য উঁচু গলায় গাইবে এরপর, মেয়েটির দিকে তাকিয়ে। তারপর গান থামিয়ে ব্যারিটোনে বলবে,
ধন্যযোগ। (সঙ্গে স্মার্ট হাসি, দাঁত দেখা যাবে না)
যোগ?
বাদ দিতে আমার ভালো লাগে না যে…
আচ্ছা! আপনি শুভদীপ তো? শুভদীপ নাগ?
আরে! কী কান্ড! আপনি আমায় চেনেন? স্টেজে দেখেছেন বোধয় তাহলে… ইয়ে, কোন নাটক জানতে পারলে একটু রিভিউ ভিক্ষা করি?
(মেয়েটা উত্তর দিল না। শুধুই হাসল। হাসিটা বেশ সরল গোছের। সুন্দরী মেয়েরা এত সহজ হাসি দেয় না। কিন্তু এটা কীরকম হল? স্ক্রিপ্টের বাইরে গেল কেন?)
বলবেন না, তাই তো?
আরে বলব, তাড়া কী?
ওহ… তাহলে দীর্ঘক্ষ্ণ কথা চালানোই যায় বলছেন?
(মেয়েটির দিকে স্লাইট ঝুঁকে একটা ভুরু তুলে এই প্রশ্নের ডেলিভারি অত্যন্ত সেক্সি দেখায়। এসবও আবিষ্কার। অভিনেতাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাইকোলজিক্যালি অর্ধনারীশ্বর হতে হয়। এটা অবশ্য, কোন এক মহিলা ফিলজফার বলেছিলেন, যে কোনো শিল্পীর ক্ষেত্রেই নাকী সত্যি। ‘The best creative minds are androgenous”. কে যেন বলেছিল?)
ভার্জিনিয়া উলফ।
অ্যাঁ!!! (শুভদীপ সিরিয়াসলি চমকালো। মেয়েটা কী থট-রিডিং জানে নাকী!! একটু আনসেটল্ড লাগছে তার।)
আমার প্রিয় লেখক ভার্জিনিয়া উলফ। আপনার? লম্বা কথা চালাতে হলে তো এগুলো দিয়েই শুরু করতে হয়… তাই…
আমার শরদিন্দু। ইংরেজি সাহিত্য তেমন পড়িনি, ক্ষমা করবেন। ঐ ডিপার্ট্মেন্টে বড়ই দুর্বল। (এবারের হাসিটা কনফিডেন্স ফিরে পাওয়ার হাসি।)
শরদিন্দু? সে তো আমিও পড়ি অনেক। ব্যোমকেশ তো বটেই, ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলোও দারুণ এঞ্জয় করি! এসব অবশ্য আমার পার্টনার পড়িয়েছে আমাকে, তাই। আমি নিজে নইলে বাংলা সাহিত্য প্রথমদিকে ছুঁয়েও দেখতাম না…
পার্টনার… মানে বয়ফ্রেন্ড? (আঁতেল আমার… ‘পার্টনার!’ ভাবা যায়?)
আজ্ঞে না। পার্টনার।
বিজনেস পার্টনার?
আজ্ঞে না। হোম পার্টনার। আমরা একসাথে একটা ঘর তৈরী করেছি।
ঘর… তৈরী করেছেন? মানে… আপনি… আর্কিটেক্ট? নাকী আপনার পার্টনার?
আর্কিটেক্ট? সে তো বাড়ি বানায়। ‘ঘর’ জিনিসটা মানুষ তৈরী করে। সাধারণ মানুষ।
ওহো, বুঝলাম। (কী নেকী রে!) তা ঐজন্যেই তো জিগালুম… বয়ফ্রেন্ড? বর? তাই তো? আপনি আবার হালফ্যাশান মতে তারে পার্টনার বলেন তা বুঝলুম… আমি কিন্তু বৌকে বৌই বলি…
উঁহু। বর নয়। বয়ফ্রেন্ড নয়। পার্টনার।
সেটা কেমন জিনিস?
ধরুন… বন্ধু?
বন্ধু? বন্ধুর সাথে ঘর বাঁধে নাকী কেউ?
আজ্ঞে, বাঁধে।
অ… তার মানে বন্ধুকেই বিয়ে করেছেন বলুন।
আজ্ঞে না। বিয়ে করিনি। বললাম তো।
আচ্ছা বুঝলাম। একসাথে থাকেন। ঐ হল। তো আপনার ‘তিনি’ কী করেন? আর আপনিই বা কী করেন?
ও বাড়িতেই থাকে। লেখেটেখে। ওর বই বেরোবে পরের বছর একটা। আমি নিউজপেপার কর্মচারী। টি ও আই।
যাক… ভালো। প্রেমিক সাহিত্যিক হলে জীবন অনেক বেশী রঙ্গিন হয়, মানতেই হবে। আমি নিজেও লিখতাম এককালে… টুকটাক… এখন…
প্রেমিক নয়।
ওহ… ‘বন্ধু’। দেখুন ম্যাডাম, সোজাসুজি একটা কথা বলি। দুটো মানুষ একে অপরকে ভালোবেসে একসাথে থাকলে তারা বিয়ে না করে থাকলে তাদের সোজা বাংলায় প্রেমিক-প্রেমিকাই বলে। আপনারা এসব নিউ-এজ শব্দ ব্যবহার করেন অবশ্য… ‘বন্ধু’, ‘পার্টনার’… ইত্যাদি, কিন্তু আমার ফ্র্যাঙ্কলি এগুলোকে ন্যাকামিই মনে হয়। আরে প্রেমিক বলতে আপত্তি কোথায়?
আপত্তি নেই তো। বলতাম, যদি হত।
প্রেমিক নয়?
না। একেবারেই না।
তবে কী হাউসমেট।
ঐ যে বললাম, পার্টনার। আমি ওকে ভালোবাসি, রক্ষা করি, যত্ন করি। ও’ও আমাকে… যতটা পারে। আমরা একসাথে আছি। উই আর আ ইউনিট।
তো সেটাকেই তো প্রেম বলে, নাকী?
কে জানে? বললে বলে। কী বলে তাই নিয়ে গত তিন বছর না ভেবেই তো চলে গেছে।
ছাড়ুন… বাদ দিন (তির্য্যক হাসিসহ)… তবে আমি যদি কারো সাথে বিছানা শেয়ার করে থাকি, আমার তাকে প্রেমিকা বলতে বাধেনি কখনো… এসব অবশ্য…
বাসটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে থামল। মেয়েটা তড়িঘড়ি ব্যাগ গুছিয়ে উঠে দাঁড়াল।
আচ্ছা, এবার আমি নামব। গড়িয়া এসে গেছে…
আরে, গড়িয়া এসে গেছে? আমিও তো এখানেই নামব… দাঁড়ান। টিকিটটাও করা হয়নি… দেখেছেন?
বাস থেকে নেমে শুভদীপ মেয়েটির পাশাপাশিই হাঁটতে থাকে। কৃষ্ণার বাড়ি তো পালিয়ে যাচ্ছে না। গেলেই হল। বাড়িটা মনে আছে, রাস্তাটা একটু রিকল করতে হবে। এখনো এখানেই থাকে, খোঁজ পেয়েছে। বাড়ি থেকে নাকী খুব একটা বেরোয় না। বাবা মারা যাওয়ার পর একেবারেই একা থাকে এখন… এক্কেবারেই একা। যাকগে, সে দেখা যাবে। এই মেয়েটাকে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছে। কিন্তু এভাবে পাশাপাশি হাঁটতে থাকলে আবার হ্যাংলা ভাবতে পারে…
এই, আপনাকে ফলো করছি ভাবছেন না তো আবার? আমি কিন্তু ইন্সিডেন্টালি ওইদিকেই যাচ্ছি…
সেরকম কেন ভাবব? আমরা তো গল্পই করছিলাম।
বেশ বেশ, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। তা… আপনি এখানেই থাকেন?
হ্যাঁ… আপনিও?
আরে না… আমি যাচ্ছি আমার এক প্রাক্তন প্রেমিকার বাড়ি। অনেকদিন বাদে।
আচ্ছা! ইন্টারেস্টিং ব্যাপার তো? হঠাৎ? ও আচ্ছা… প্রেম ভেঙ্গে যাওয়ার পর বন্ধুত্ব থেকে গেছে… তাই?
নাহ, তা ঠিক না। সে জানেও না আমি আসছি। আসলে… এই মেয়ে ঠিক আমার প্রেমিকাও ছিল না, বুঝলেন… সে ছিল আমার প্রেমে পাগল। কিন্তু আমার কোনোদিনই প্রেমটা পায়নি আর কী… তা আমি বিয়ে করছি শুনে সে নাকী আবার সুইসাইড করতে গেছিল শুনেছি। মাথার দোষ আছে আসলে। বিয়ে, সংসার, কিছুই নাকী করেনি। তো… এই, যাচ্ছি একবার… দেখে আসি। খবর নিয়ে আসি। একা একা থাকে…
আচ্ছা… কত বছর বাদে?
তা প্রায়… বছর পাঁচেক যোগাযোগ নেই।
হঠাৎ পাঁচ বছর বাদে খোঁজ নিচ্ছেন যে?
হ্যাঁ… এই প্রশ্নটা… ঠিক এটাই… শুভদীপের মাথায় ঘুণপোকার মত কুরকুর করছে গতকাল থেকে। সে যাচ্ছেটা কেন? কিন্তু শুভদীপের জীবনে কোনো প্রশ্নই বেশীক্ষণ উত্তরহীন থাকে না, নিজের মাথার মধ্যেও নয়। তিন চারটে উত্তর সে ভেবে রেখেছে। যথা… মানবিকতা বলেও একটা ব্যাপার আছে। এতদিন বাদে দেখা করলে মনের মেঘ কাটবে হয়তো মেয়েটার… বেচারী একটু শান্তি পাবে। খুব অ্যাবরাপ্ট হয়েছিল তো ব্রেকাপটা… কিচ্ছু না বলেকয়ে যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিল শুভদীপ… তা এতদিন সময় কাটিয়েছে একসাথে, একটু সিম্প্যাথি অন্তত… এসব রিয়ালিস্টিক উত্তরের আড়ালে অবশ্য যে আসল উত্তরটা রয়েছে, তা শুভদীপ নিজেও খুব ভালো করে জানে। কিন্তু সে উত্তরটা নিজেকে দিতেও খানিক সঙ্কোচ হয়। অথচ এই গড়িয়ার আধচেনা গলির মধ্যে সেমি-চেনা এই মেয়েটাকে সে মুখ ফসকে ঠিক সেই উত্তরটাই দিয়ে ফেলল? এবং, কী আশ্চর্য্য, শুভদীপ নাগের মুখও ফস্কায়!
কৃষ্ণ আবার কখনো সখনো মীরাবাঈয়ের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে দেখাও দিয়ে ফেলে যে!
(মেয়েটা আবারও হাসল। সেই সহজ হাসিটা। একটা প্রাকবসন্ত হাওয়ায় মেয়েটার চুল উড়ে যে মুখের ওপর পড়ছে, এটা বেশ ভয়ানক পরিস্থিতি তৈরী করছে কিন্তু…)
সে কী ম্যাডাম! উইমেন্স লিবের কী হল? একটা সাঙ্ঘাতিক সেক্সিস্ট কথা বললাম যে… জুতোপেটা করবেন না?
আপনি মীরাবাঈয়ের গল্পটা জানেন?
জানব না কেন?
আপনার মনে হয়… মীরাবাঈ ব্যক্তিসাধনা করেছিলেন? কৃষ্ণ একটা আইডিয়া। একটা বিশ্বাস। সেই বিশ্বাসটাকে টিকিয়ে রাখার জন্য, সেটাকে রক্ষা করার জন্য লড়াই করেছিলেন মীরাবাঈ… কোনো মূর্ত্তির জীবন্ত হয়ে ওঠার অপেক্ষা সেটা বোধয় ছিল না… তাই না?
হুম… তা বটে। আরে দূর, সিরিয়াসলি নেবেন না… ও কথাটা হাল্কাভাবেই বলেছি। অনেকদিন পর হঠাৎ মনে হল, একবার দেখা করে আসি। এইই… আর কোনো কারণ নেই।
মেয়েটি হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল।
পাঁচ বছর আগে এসেছেন… এখন চিনতে পারবেন, বাড়িটা?
ইয়ে… ঐ জিজ্ঞেস করেটরে…
দেখি, ঠিকানাটা? লেখা আছে?
ঠিকানা লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে মেয়েটি বলল, ‘আসুন, আমার সঙ্গে’। আর একটু এগিয়ে, একটা মোড় ঘুরেই শুভদীপ বাড়িটা দেখতে পেল। চিনতেও পারল… এই বাড়িরই একটা ফ্ল্যাটের একটা ঘরে বেশ কিছু স্মরণীয় সন্ধ্যা কেটেছে এক সময়ে… অনেকদিন আগে। তবু… আচ্ছা… বুকের ভেতর যে হাল্কা চিনচিনটা… ওটা কী ভয়? আশঙ্কা? কেন? শুভদীপ তো জানে… তাহলে? নাকী… সংশয় হচ্ছে? যদি তাড়িয়ে দেয়? অপমান করে যদি? নাহ… ইম্পসিবল। শুভদীপের জন্য পাঁচ বছর অপেক্ষা করে আছে কৃষ্ণা। একটা ইমেল করেছিল… শুভদীপের বিয়ের পরের দিন। শুভদীপ জানে…।
সে দেখল, মেয়েটা অলরেডি সিঁড়ি দিয়ে উঠতে শুরু করেছে। শুভদীপও এগোলো। আচ্ছা… মেয়েটা জানল কী করে কোন বাড়ি? ও কী বলেছে নিজেই? না তো? তাহলে ঠিকানা দেখেই এক চান্সে পেয়ে গেল? তাইই হবে… মেয়েটা ব্রাইট।
সত্যিই, খুবই ব্রাইট। একেবারে ঠিক দরজার সামনেই এসে দাঁড়িয়েছে তারা। দরজাটা দেখেই বুকের চিনচিনটা… কিন্তু না, বুকের কথা মুখে এলে চলবে না। শুভদীপ নাগ আর পাঁচজন নয়, যে মুখ দেখে মনের খবর বোঝা যাবে। কলিংবেল বাজিয়ে দিয়েছে মেয়েটাই। আর কয়েক সেকেন্ড।
শুভওওওও… এক মিনিইইইইট… আসছিইইইই… এক মিনিট দাঁড়া, শুভ…
মেরুদন্ড দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাওয়ার কথা শুভদীপ এযাবৎ বইয়ে পড়েছে… আসলেই ওরকম হয় তা বিশ্বাসও করত না… ফিকশন তো এক্স্যাজারেশন… ফলে… কিন্তু আজ সম্যক অনুভূত হল, স্রোতটা।
কাকে ডাকছে কৃষ্ণা? কৃষ্ণার গলাই তো! কৃষ্ণাই তো ‘শুভ’ বলে ডাকত ওকে, নাকী!! তাহলে কী… তাহলে কী… পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছে? কলিংবেল বাজলেই ভাবে শুভ এসেছে? এতটা!! এতটা??? শুনেছিল বটে… কিন্তু… গলার কাছে কী একটা দলা পাকিয়ে আটকে গেছে… চোখ জ্বালা করছে… শুভদীপ কী পালাবে? হ্যাঁ, পালাতে হবে…! এটা ফেস করতে পারবে না… জাস্ট পারবে না!
মেয়েটা হাসছে কেন? স্মাইল নয়… শব্দ করে হাসছে… কেন হাসছে? কেন? ইজ দিস আ জোক? ইজ দিস আ ফাকিং জোক? কিন্তু কী করে? কী করে? ও যে এখানে আসছে তা তো ও নিজে ছাড়া আর কেউ জানত না? কেউ না…? আচ্ছা… তাহলে কী… এই মেয়েটা কৃষ্ণার বন্ধু… ওর কাছে ছবি দেখেছে শুভদীপের… বাসে দেখে চিনতে পেরে আলাপ করেছে… তারপর এই হাঁটতে হাঁটতে আসার সময়ে টেক্সট করে জানিয়ে দিয়েছে কৃষ্ণাকে? টেক্সট করতে তো দেখেনি? কী হচ্ছে এটা??!! ষড়যন্ত্র!! ডু দে থিংক শুভদীপ নাগ ইজ আ ব্লাডি ফুল???!!!! হাউ ডেয়ার দে!!!!
শুভদীপের গলাটা শুকিয়ে আসছে। একটু জল খেতে হবে। এখনো দরজা খুলছে না কেন ঢেমনি!!
আপনি এত টেনশন নিয়ে ফেলবেন না… কৃষ্ণা আমাকে ‘শুভ’ বলে ডাকছে… আপনাকে নয়… (হাসতে হাসতে বলল মেয়েটি)।
আপনাকে???? মানে????
আমার সঙ্গে এত গল্প করলেন, অথচ নামটাই জানতে চাইলেন না একবারও। আমার নাম শুভাঙ্গী। শুভাঙ্গী মুখোপাধ্যায়। নমস্কার। প্লিজড টু মিট ইউ। এটা শুধু কৃষ্ণার নয়, আমারও বাড়ি। আমরা একসঙ্গে থাকি। একসঙ্গে ঘর বেঁধেছি বলতে পারেন। পার্টনার আমরা।
কৃষ্ণা…
লেসবিয়ান বা বাইসেক্সুয়াল এখনো নয়। আমিও নই। তবে হলে দুজনেরই ভালো হত, আই গেস। যাকগে… ইটস নট অ্যাবাউট সেক্স। ইটস অ্যাবাউট লাভ। ভালোবাসা বলে যে বিশ্বাসটা, ওটাকে রক্ষা করছি আমরা। যত্নে লালন করছি। কাউকে কোনো এক্সপ্ল্যানেশন না দিয়েই করছি। কৃষ্ণা শুধু একজন মানুষ নয়, একটা আইডিয়া। অ্যান আইডিয়া ওয়র্থ প্রোটেক্টিং।
আম… আমি…
ভেতরে এসে বসুন আগে। জলটল খান। আপনাকে বাসেই দেখে চিনেছিলাম। ছবি দেখেছি তো। এমনিই একটু বাজিয়ে দেখব বলে পরিচয়টা দিইনি। তবে আপনি এতটা ভয় পেয়ে যাবেন জানলে দিয়েই দিতাম… সরি। আসুন।
দরজা খুলে যে দাঁড়িয়ে আছে সে কৃষ্ণাই বটে। ভিজে চুল তোয়ালে দিয়ে জড়ানো। মুখটা আগের চেয়ে অনেক বেশী উজ্জ্বল। একেই বোধয় ‘ডোমেস্টিক ব্লিস’ বলে। অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে, চোখ বড় বড় করে… যেন ‘বিস্ময়’ শব্দটাকে কেউ সন্দেহবাতিকের ধুলো থেকে তুলে ঝেড়েমুছে সাজিয়ে রেখেছে ওর চোখের পাতায়।

Facebook Comments


Tags :