মাছি
“কতদিন থেকে হচ্ছে আপনার এটা?”
” মাস দুয়েক”
” ইরেসিস্টেবেল ফিয়ার দ্যাট ইয়োর বয় ফ্রেন্ড উইল কিল ইউ? নাকি কোনো সেক্সুয়াল ডমিনেশানের ডিজায়ার?”
” না, অনলি ফিয়ার। হি উইল স্ট্যাব মি টু ডেথ”
”আপনার প্রেমিক লয়াল?”
”ভয়ানক, সারাদিন পড়াশুনো করে। হি ইজ অ্যা রিসার্চার। অন্য মেয়েদের প্রতি আগ্রহ নেই, চোখে হারায় আমাকে।”
”সে কি ওভার পজেসিভ? ভায়োলেন্ট?”
” খুব শান্ত ডিসেন্ট ছেলে। কুল হেডেড। পজেসিভ নয় তেমন। মানে স্বাভাবিক যেমন হয় রিলেশানশিপে।”
”আপনার আর কোনো সিম্পটম?”
”ঘুম হয় না, রাতে দিনে কখনোই। বাট আই ডোন্ট ফিল টায়ার্ড। কন্সেন্ট্রেট করতে সমস্যা হয় একটু। আর মাছি।”
”মাছি!”
”হ্যাঁ তিন চারটে মাছি যখন তখন মুখে এসে বসে।”
একটু থামলেন ডক্টর দত্ত, তারপর খসখস করে প্যাডে কিছু লিখে নিলেন।
”আপনি অ্যাকিউট কেস অফ অ্যা ংজাইটি লিখলেন।”
চমকে মুখ তুললেন ডক্টর। সামনের চশমা পরা রোগা মেয়েটা নির্বিকার মুখে বসে আছে।
”দেখে নিলেন আপনি সেটা?”
”হাতের বাঁক দেখে আমি মোটামুটি লেখা বুঝতে পারি, রাকু আর আমি প্রায়ই এই ব্যাপারটা প্র্যাক্টিস করে থাকি।”
”ইন্টারেস্টিং!”
”তেমন না, প্র্যাক্টিস শুধু।”
”রাকু আপনার…”
” প্রেমিক, যে আমাকে খুন করবে।”
অদ্ভুত শান্ত ভাবে কথা গুলো বলে চলেছে মেয়েটা। ঠিক উত্তেজিত মানুষের ভঙ্গি বলে মনেই হচ্ছে না। অথচ কোন আনকন্সাস লেয়ারে কি টারময়েল চলছে সেটা খুঁজে না বের করলে…
”আমি কতগুলো ঘুমের ওষুধ লিখে দিচ্ছি, একটু হাই ডোজের। সাথে একটা অ্যান্টি ডিপ্রেস্যান্ট। দুই সপ্তাহ পরে আবার আসুন।”
”অ্যালজোলামে আমার কাজ দেয় না।”
”অ্যালজোলাম দিইনি, কাজ দেবে, ভরসা রাখুন।”
”ভরসা… ওহ…” হঠাত ডুকরে কেঁদে উঠলো মেয়েটা।
******
চেম্বার থেকে বেরিয়ে ওলা বুক করলো রূপসা, মিনিট তিনেক লাগবে পিকড আপ হতে। এই মিনিট তিনেকে ফ্রন্ট ক্যামেরা দিয়ে চোখের মেক আপ টা ঠিক করে নেওয়া যাবে। বুড়ো ডাক্তার টা ভালো, সে যখন কাঁদছিল , কোনো কথা বলেনি। কান্না থামার পর টাস্ক দিয়েছে। ভালো থাকা আর আনন্দে থাকার মধ্যে পার্থক্য কাকে বলে সেটা লিখে আনতে পরের দিন। আনন্দ, হাহা! এই যে হাতের মুঠোয় প্রেস্ক্রিপশানে এত গুলো ঘুমের ওষুধের নাম, এই হলো আনন্দ।
সাদা সিডান বুক করেছে, মাথা খেলিয়ে ভাবতে গেলে একটু বেশি জায়গাই লাগে। ওলা তে উঠে ড্রাইভারকে কলেজ স্ট্রিট এর ডিরেকশান দিয়ে ফোনের সেকেন্ড সিম টা অ্যক্টিভেট করল সে।
তারপর ঐ বিশেষ নাম্বার টা ্ডায়াল করলো খুব স্লো লি।
পার্ক সার্কাসের বেশ পশ একটা এপার্টমেন্টের ফিফথ ফ্লোরে ঠিক সেই মুহুর্তে বেজে উঠলো কেয়ারলেস হুইস্পার।ক্লায়েন্ট নাম্বার বাইশের জন্য এই রিংটোন টা সেভ করেছে রাজর্ষি।
ইউটিউবের ভিডিওটা মিউট করে ফোনটা ধরলো সে।
-”বলুন।”
-” আপনার অ্যাসাইনমেন্ট ক্যান্সেল হলে অ্যাডভান্স ফেরত দেন?”
অদ্ভুত হাস্কি গলা মহিলার, যতদূর সম্ভব ভয়েস মডিউল করে কথা বলছে।
-” যদি আমার অপারগতায় হয় তবে ওয়ান থার্ড ফেরত দিই। যদি ক্লায়েন্ট ক্যান্সেল করে তাহলে ফেরত দিই না।”
-”আমি এই অ্যাসাইনমেন্ট টা ক্যান্সেল করছি। অ্যাডভান্সের দশ হাজার ফেরত চাই না।”
মহিলা বেশ ইনকন্সিস্টেন্ট তো! যাই হোক। যতদূর সম্ভব প্রফেশনালি রাজর্ষি উত্তর দিলো,
-”ওকে ম্যাম। ইটজ বিন এ প্লেজার ডুইং বিজনেস উইথ ইউ।”
ওপাশের সংযোগ কেটে গেলে মনে মনে দুটো খিস্তি দিয়ে ইউটিউব ভিডিও টা আবার চালালো সে।
রুপুর জন্মদিনের জন্য কেক বানানো শিখছে, এমন সময় যত্ত ইনকন্সিসস্টেন্ট ক্ল্যায়েন্টের কল!
ফোনটা রেখে সিম খুলে নিলো রূপসা, তারপর দাঁতে কেটে চার টুকরো করে বাইরে ফেলে দিলো।
জয় হোক ভয়েস মডিউলেশান, জয় হোক থিয়েটার ক্লাসের।ড্রাইভারকে বলল, “ভাইয়া এক মেডিক্যাল শপ দেখকর ঠহরনা। জরুরি মেডিসিন লেনা হ্য।”
*****
দশটা বাজতে চলল, এখনো বাবুর টিকির দেখা নেই। হাতের বই মুড়ে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ঠিক এটাই ভাবছিলো রূপসা। ঘুমের ওষুধ গুলো গুঁড়ো করে রেখে দিয়েছে হাউসকোটের ডান পকেটে। রেড ওয়াইন বাড়িতেই আছে। এবার শুধু অপারেশান কত সূক্ষ্ম ভাবে করতে পারে তার অপেক্ষা।
পাতলা একটা হাসি ফুটে উঠলো তার মুখে, বিখ্যাত সাইকোলজিস্ট কেও বোকা বানিয়েছে সে।
আয়েসি ভাবে আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে দাঁড়ালো সে, তারপর পায়ে পায়ে ঘরের জানলাটা খুলে দিল।
রাকু কে কেন সে মারতে চায় তার কাছে খুব পরিষ্কার তার কারণ, রাকু সিমপ্লি তার। এতদিন পর্যন্ত সেই ধারণাই ছিলো। কিন্তু মাস দুয়েক,হঠাত রাকুর ফোনে বিভিন্ন সময়ে ফোন, সাঙ্কেতিক কথা, বিভিন্ন রকম রিংটোন, যখন তখন আন অ্যাভেলেবল… রাকু যে কিছু লুকোচ্ছে তার থেকে জলের মত স্বচ্ছ হয়ে এসেছে এখন। ঝগড়া সে করতে পারে না, তাছাড়া কোনো কংক্রিট প্রমাণ নেই, রাকু যে তাকে অবহেলা করছে বলা যাবে না। তবু রূপসা জানে, বোঝে, মেয়েদের সিক্সথ সেন্স,রাকু কে সে যেতে তো দেবে না অন্য কোনো মাগীর কাছে! দরকার হলে খুন করে শরীর প্রিজার্ভ করে রাখবে তবুও… উফফ সেই মাছি গুলো আবার এসেছে। এই মাছিগুলোর কথাই এক মাত্র সত্যি বলেছিলো সে ডক্টর দত্তকে। রাকুর পরিবর্তন শুরু হওয়ার কয়েকদিনের মধ্যে এই মাছির জ্বালাতন শুরু হয়েছে। তিন চারটে যখন তখন কোথা থেকে এসে চোখে মুখে বসতে থাকে। অসহ্য। স্কিনের কিছু সমস্যা কি! নাকি ভিশন প্রবলেম! আজকের কাজ হলে একবার ভালো করে স্পেশালিস্ট দেখাতে হবে।
বিরক্তিতে কিচেনে গিয়ে চোখে মুখে জল দিলো সে। তারপর আবার জানলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালো, মাস দুয়েকের ঘটনাবলীতে চোখ বোলাবে বলেই।
সিরিয়াল কিলার দিয়ে খুন করানোর আইডিয়াটা ডেক্সটার দেখে পেয়েছিলো। তারপর নাম্বার যোগাড় করা, সুপারি দেওয়া, কিন্তু মন মানছিল কই।পজেসিভনেস টিকটিক করছিলো, আমার প্রেমিক, আমি যা করার করবো। তাই জন্যই আজ ক্যান্সেল করে দিলো। তার মত সোহাগ করে তো আর সিরিয়াল কিলার মারতে পারবে না! পরফিরিয়াজ লাভারের অপোসিট ভার্সান অভিনীত হবে আজ।
হঠাত কাঁধে হাত পড়তেই সচকিতে ঘুরে দাঁড়ালো সে, এইত্তো রাকু, তার রাজর্ষি। জড়িয়ে ধরলো দুই হাতে। কিন্তু ঘরটায় এমন আলো আঁধার কেন, লাইট অফ করে রোম্যান্স!
ওয়াইনের বোতল টা যে কোথায় গেলো। উফ, ঘেঁটে যাচ্ছে সব। রাকু ফোনে আবার কার সাথে কথা বলছে, অ্যাসাইনমেন্ট ক্যান্সেলের কথা, ওকে ম্যাম ইটজ বিন এ প্লেজার ডুইং বিজনেস উইথ ইউ। সেও আজ একজনের সাথে অ্যাসাইনমেন্ট ক্যান্সেল করেছে, সেই লোকটাও এক কথা বলছিলো। সব অ্যাসাইন্মেন্ট ক্যান্সেল হলে কি এমন কথা বলা হয়, আচ্ছা ঐ লোকটাই কি রাকু। ক্লায়েন্ট নাম্বার বাইশ। রাকু কে খুন করতে হবে। সব কেমন ধোঁয়া হয়ে যাচ্ছে।উফ…মাছিগুলো…মাথা যন্ত্রণা…
অদ্ভুত একটা উত্তেজনা তলপেট থেকে গুলিয়ে উঠতে থাকে তার শরীর বেয়ে, তারপর তা হাসি হয়ে আছড়ে পড়ে চারপাশের সাদা দেওয়ালে দেওয়ালে।
******
পাশের ফ্ল্যাট থেকে হাসির আওয়াজ পেতেই অনির্বাণ খাওয়া থেকে হাত গুটিয়ে নিলো। পরমা বুঝলেও কিছু বলল না, চুপ করে খাওয়ায় মন দিলো আবার।
-” সিমপ্লি ডিসগাস্টিং! কিভাবে পাগলী টাকে একা ফ্ল্যাটে রেখে দিয়েছে। কোনো অ্যাসাইলামে দিয়ে দিতে পারে তো!”
-” বড় লোকের মেয়ে, আদুরে। তাই জন্য অ্যাটেন্ডেনট দিয়ে রেখেছে। মেন্টাল হোমে দিলে এরকম যত্ন তো পাবে না।”
-”আটার ননসেন্স! এতে চারপাশের শান্তিভংগ হয়। পয়সা থাকলে কি সাপের পাঁচ পা দেখা যায় নাকি! আমি পরশুর মিটিং এ কমপ্লেন করবো এটা নিয়ে।”
-” আহা থাক না, কিছু তো করে না এমনিতে। ঘর থেকেও বেরোনো নিষেধ। শুধু হাসে মাঝে মধ্যে।”
-” হাসে! ওটা তোমার হাসি মনে হয়! নরক থেকে উঠে আসা আর্তনাদ মনে হয় আমার! উফ, কেন যে এইখানে উঠে এলাম!”
পরমা একটু ঝুঁকে অনির্বাণের হাত ধরলো, “শোনো না, একটু শান্ত হও প্লিজ, জানি হাসি টা ভয়ানক, কিন্তু মেয়েটা বড় দুঃখী।.”
-” তাতে আমাদের কি? সে তো এই দুনিয়ায় কত কোটি দুঃখী মানুষ আছে! তুমি এরকম ন্যাকা কবে হয়ে গেলে পরমা?”
-”আজ শুনলাম তিনতলার মিসেস বাসুর থেকে, লিভ ইন করতো দুজন। মেয়েটা আর তার প্রেমিক।
মাস নয়েক আগে সন্দেহের বশে নিজের প্রেমিক কে বিষ মিশিয়ে খুন করেছিলো। তারপর থেকেই শকে এমন… বড়লোক শিল্পপতি বাবা, কেসটা ধামাচাপা দিয়ে দেয় কোনোভাবে, কিন্তু দেওয়ালের কানা ঘুষোতে সবাই সব জানে… ওর অ্যাটেন্ডেন্ট বলে ও নাকি সারাদিন একটা কাউচে বসে বসে খাতায় হিজিবিজি কাটে, একা একা কথা বলে, মাঝে মাঝে ট্যাক্সি চাপার অভিনয় করে, আর এমন ভাবে হাসে… “
পরমার মুখের কথা অর্ধেক অবস্থাতেই থেমে গেল, গোটা ফ্লোর আবার মেয়েটার হাসিতে ভরে উঠেছে।
Facebook Comments