অলিন্দ
একটা অলিন্দের বড় শখ কঙ্কনার| পুষ্কর বলেছিল‚ ‘রিটায়ারমেন্টের পর যখন বাড়িটা বানাব তখন তোমার জন্য একটা বারান্দা বানিয়ে দেব|’ ‘বারান্দা নয় বল অলিন্দ’ ‚ হেসে বলেছিল কঙ্কনা|
কঙ্কনার মায়েরও বড় শখ ছিল লাল মেঝের কুলুঙ্গিকাটা একটা অর্ধবৃত্তাকার অলিন্দের| তিনি তখন খুব ছোট যখন পূর্ববঙ্গ ছেড়ে চলে এসেছিলেন| ছোটবেলার অনেক কিছুই ভুলে গেলেও অলিন্দের কথাটা কিছুতেই ভোলেননি তিনি| থেকে থেকেই মায়ের নানা কথায়‚ স্মৃতিচারণে ঐ অলিন্দ যেন কঙ্কনার চোখের সামনে ফুটে উঠত| দেখতে পেত লাল মেঝের ওপর প্রখর শীতের নরম রোদ অলিন্দ পেরিয়ে ঘরের মধ্যে লুটিপুটি খাচ্ছে| গরমের বিকালে মা‚ তার অন্য ভাই বোনেদের সাথে অলিন্দে পুতুল খেলছে এইরকম টুকরো টুকরো কত যে দৃশ্য| আর তখন থেকেই কঙ্কনার বড় শখ জেগেছিল একটা অলিন্দের|
(১)
নয় নয় করে বছর দশেক কেটে গেল| আজও জমিটা তেমন টাই পড়ে আছে| বছর দশেক আগে জমিটা তার নামেই কিনেছিল পুষ্কর ‘একটু দূরে হয়ে গেল‚ কিন্তু সস্তায় পেয়ে গেলাম তাই বায়না করে দিলাম বুঝলে|’ তৃপ্তির হাসি হেসেছিল পুষ্কর| তারপর বলেছিল‚ ‘সারাজীবন তো তেমন কিছু দিতে পারিনি তোমায়| কোনদিন মুখ ফুটে তো কিছু চাইলেও না| শ্যাওলার মত ভেসে বেড়ালাম | শেষ জীবনটা একটু নিজেও থিতু হতে চাই‚ তোমাদের মাথার ওপর একটা ছাদ থাকবে| আমি শান্তিতে মরতে পারব|’
মুখটা চেপে ধরেছিল কঙ্কনা| ‘সবসময় কি যে অলক্ষুনে কথা বল‚ ভালো লাগে না|’
একটা দীর্ঘশ্বাস বুক চিরে বেরিয়ে আসে কঙ্কনার| রোজ একবার করে এসে ঘুরে যায় জমিটায়| বছর দুয়েক আগে পাঁচিল দিয়ে ঘিরে দিয়েছে পৌনে দু কাঠার জমিটা| যখন জমিটা কেনা হয়েছিল চারিদিক ছিল শুনশান| ঘরবাড়ি বলতে মাইল খানেকের মধ্যে গোটা দুই বেড়ার ঘর| ইলেকট্রিক লাইন নেই‚ জলের বন্দোবস্ত ও কিছুই ছিল না| এখন অবশ্য ইলেকট্রিকের লাইন এসেছে| চারবার টাইম কলের জল আসে| ঘরবাড়িও বেশ কিছু গড়ে উঠেছে| কিন্তু রাস্তাঘাটের তেমন উন্নতি এখনো চোখে পড়ে না| সন্ধ্যেবেলাগুলো যেন ভুতুড়ে মনে হয়| তখন ভাবত কি করে এই গন্ডগ্রামে এসে থাকবে? দোকানপাট বলতে কিছুই নেই| মেয়ে টুসির স্কুল আছে‚ পুষ্করের অফিস এত দূর থেকে সেসব কি করে করবে? তবু নিজের এক চিলতে জমি এই অনুভবটা বুকের খাঁচায় যেন বিশুদ্ধ প্রাণবায়ু ভরে দিয়েছিল| একটা একতলা ছিমছাম বাড়ি আর একটা অর্ধবৃত্তাকার অলিন্দের কল্পনায় মন বিভোর হয়েছিল| একতলা বাড়িতে অলিন্দ হয় না নাকি! হয় হয়| কিন্তু বাড়িটা দাঁড় করিয়ে যেতে পারল না পুষ্কর|
রোজকার মাংস-পোলাও সংসার ছিল না বটে‚ তবে অভাব বোধও ছিল না| বেশ সুখেই তো কেটে যাচ্ছিল দিনগুলো| তারপর হঠাৎ করেই সব নিভে গেল| সেদিন জ্বর নিয়ে বাড়ি ফিরল পুষ্কর| জ্বর‚ খুব সাধারণ জ্বর| দুদিনের দিন সেই সাধারণ জ্বরেই ভর্তি করতে হল হাসপাতালে| প্যাথোলজিক্যাল টেস্ট করেও বিশেষ কিছু পাওয়া গেল না| অথচ জ্বরটা কিছুতেই কমছিল না| হিমোগ্লোবিনও তলানীতে এসে ঠেকেছিল| রক্ত‚ স্যালাইন সবই চলছিল| সমস্ত সঞ্চয় দিয়ে প্রাণপণে চেয়েছিল পুষ্কর যাতে বেঁচে ওঠে| কিন্তু ডাক্তাররা আশা দিতে পারেন নি| তারপর সব শেষ|
রোজ আসতে আসতে এই এলাকার অনেক লোকের সাথেই আলাপ – পরিচয় হয়ে গেছে| তারাই বলেছিল‚ জমিটা ঘিরে রাখুন‚ দিনকাল ভালো না| কখন কোন ক্লাব খুঁটি পুঁতে দেবে তখন তাদের হাত থেকে মুক্তি পেতে কত গচ্চা দিতে হবে তার কোন ঠিক নেই| পুষ্কর চলে যাবার পর বাড়িটা ছেড়ে দিতে হল| সব পাওনা গন্ডা বুঝে নিয়ে কাছাকাছি একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে এসেছিল কঙ্কনা| মেয়েকে স্থানীয় স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল| বাড়িতে বসে টুকটাক সেলাই-ফোঁড়াই এর কাজ শুরু করেছিল|
চোখের সামনেই দেখল এলাকা কত উন্নত হচ্ছে| পালটে যাচ্ছে| চারটে খুঁটি পুঁতে একটা ঘর করার ইচ্ছে ভেতরে ক্রমে ক্রমে ডানা মেলছিল| কিন্তু সাধ আর সাধ্যের মেলবন্ধন এইসব ক্ষেত্রে কবেই বা ঘটেছে? টুসির ওপর খুব ভরসা করেছিল| দিন রাত এক করে মেয়ের সাথে লেগেছিল যাতে রেজাল্ট ভালো হয়| সাধ্যের বাইরে গিয়েও কোচিং দিয়েছে| কিন্তু সব আশায় জল ফেলে দিয়েছে টুসি| কোনরকমে মাধ্যমিক আর টেনেটুনে উচ্চমাধ্যমিক পাশ দিয়ে টুসি পালিয়ে গেল পাড়ার সবচেয়ে বখাটে ছেলের সাথে| ছেলেটার চরিত্রই ছিল আজ এ ডালে তো কাল ও ডালে| কতবার রাস্তায় কত মেয়ের সাথে দেখেছে তার ইয়ত্তা নেই| কিন্তু নিজের মেয়েই যে ঐ ফাঁদে পা দেবে কল্পনাতে ছিল না| টুসিকে কতবার বলেছিল ‘ তোর বাবার টাকা আমি খুব ভেবেচিন্তে খরচ করছি টুসি| তুই পাস করে একটা চাকুরী পেলে সেই টাকায় সংসার চালাবো আর তোর বাবার টাকা দিয়ে জমিটায় একটা ঘর দেবো‚ হোক না টিনের চাল বা টালির‚ তবু নিজের তো হবে| ভাড়ার টাকাটা তো বাঁচবে|’ ঘুণাক্ষরেও টের পায়নি মেয়ে চলেছে পাতায় পাতায়| টুসি বিয়ে করে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল| কষ্ট-দুঃখ‚ গ্লানি ‚ ঘৃণা সব উগড়ে দিয়েও মেয়েটাকে ফিরিয়ে দিতে পারে নি কঙ্কনা| একটা মাত্র মেয়ে তো‚ ক্ষমা করে দিয়েছিল| কিন্তু জামাইকে মেনে নিতে পারেনি| তাই টুসির জন্য তার দরজা খোলা থাকলেও জামাই-এর জন্য মনে কোন ঠাঁই ছিল না|
বিয়েটা মাসকয়েক ও টিকলো না| টেঁকার কথাও ছিল না| মাসকয়েক আগে এসে টুসি পাকাপাকিভবে থেকে গেল| টুসি এখন কুড়ি বছরের পুর্ণ যুবতী| কোলে এখনো কোন সন্তান আসেনি এই যা রক্ষে| যে ছেলেটির সাথে পালিয়েছিল‚ বিয়ে করেছিল সে আবার অন্য একটি মেয়েকে নিয়ে পালিয়েছে| সম্পর্ক চুকিয়ে বুকিয়ে দিতে চায় টুসি| কঙ্কনার সায় আছে| একটা ভুলকে নিয়ে সারাজীবন বয়ে বেড়ানো যায় না| শুধরে নেবার সুযোগ এসেছে যখন শুধরে নেওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ| আর এত আর কোর্টে রেজিষ্ট্রি করে বিয়ে নয়‚ মোহের বশে কালীতলায় গিয়ে সিঁদুর পড়ে আসা| কঙ্কনাও রেজিস্ট্রি করার জন্য চাপ দেয়নি| বুঝেছিল এ সম্পর্কের মেয়াদ বেশি না| সিঁদুর মুছে টুসি আবার লেখা পড়ায় মন দিয়েছে| তবে কঙ্কনা আর তেমন কিছুই আশা করে না| আসলে সবই কপাল‚ মাঝে মাঝে ভাবে কঙ্কনা|
‘দিদি চা ধরুন|’ মনোরমা‚ তাদের জমির ঠিক উল্টোদিকের এক তলা বাড়িটা ওদের| রোজ এক কাপ চা করে এনে সন্ধ্যের মুখে হাজির করে মনোরমা| রোজ নিয়ম করে জমি দেখতে আসলেই সময় যে কোথা দিয়ে বয়ে যায় টের পায় না কঙ্কনা| এখানে সবচেয়ে বেশি আলাপ এদের সাথেই| বাড়ির সংলগ্ন ধাপিতে দুজনে চায়ের কাপ নিয়ে বসে|
‘মেয়ের খবর কি দিদি?’
‘সবই তো জানেন‚ নতুন করে কি আর বলব’| কঙ্কনা চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বলে|
মনোরমা চুপ করে যায়| কিছুক্ষণ পর বলে‚
‘দিদি একটা কথা বলব?’
‘হ্যাঁ বলুন না’|
‘বলছিলাম কি দিদি একা মেয়েমানুষ আপনি‚ এখন এই বাড়ি করতে অনেক সমস্যা| সিন্ডিকেটের ঝামেলা আছে‚ মেটিরিয়াল বাজে দেবে‚ আশে পাশে ক্লাবকে খুশী করতে হবে| দূর দূরান্তে লোকে জমি কেনে অল্প দামে| কিন্তু এসব অঞ্চলের এইসব খাঁই মেটানো যে কি ঝক্কির আমি টের পেয়েছিলাম|’ একসাথে এতগুলো কথা বলে থামে মনোরমা|
কঙ্কনা বোঝার চেষ্টা করতে থাকে ঠিক কি বলতে চায় মনোরমা এইসব অবতরণিকার মাধ্যমে| আগেও বার দুই কথা তুলেছে‚ কিন্তু কোনবারই কোন না কোন কারণে পুরো কথাটা শোনাই হয় নি|
‘তাই বলছিলাম কি দিদি‚ এখন তো দেখছেন দিন দিন এই এলাকা উন্নত হচ্ছে| খুব বেশি দেরী নেই এখানে চওড়া রাস্তা বের হতে| তখন দেখবেন প্রোমোটিং -এর জন্য লোকে কেমন হামলে পড়ছে| আপনি তখন কোন ভালো প্রোমোটার দেখে জমিটার একটা হিল্লে করে দেবেন|
কঙ্কনা চুপ করে থাকে| মনোরমা জানে কঙ্কনার সাধ্য নেই একটা একতলা ঘর দাঁড় করানোর| জমা পুঁজি যা আছে তাতে সে হাত দেবে না| তাহলে ভবিষ্যত চলবে কি করে| মাসে মাসে এত টাকা ভাড়া সেটাও তো গায়ে লাগে| তাই চায় একটা একতলা ঘর করতে| কতবার তো মনোরমাকেই বলেছে এই কথা|
‘সে সব হতে তো অনেক দেরী মনোরমা| আগে এলাকা উন্নত হোক‚ যাতায়াতের ব্যবস্থা ভালো হোক তবে না|’
‘সে তো জানি দিদি‚ আরে আপনার তো এখনি বাড়ি হচ্ছে না| আর দেখুন বাড়ি করার ঝামেলা বাদে টাকা পয়সাটাও তো একটা ব্যাপার| খারাপ ভাববেন না দিদি‚ আপনাকে নিজের মনে করি তাই বললাম|’
নাহ কি বা মনে করার আছে কঙ্কনার| পুষ্করের খুব ইচ্ছে ছিল বাড়ির পাঁচিল ধরে লাগাবে ফুলগাছ| বেশ ছবির মত একচিলতে বাগানের মধ্যে একটা ছোট্ট বাড়ি| সেসব ভেবে আজ আর কি কাজ| তবে প্রস্তাবটা মন্দ নয়|
‘চা শেষ| এখন উঠি মনোরমা| আবার কাল আসব|’ কঙ্কনা উঠে পড়ে রোজকার মত হাঁটতে হাঁটতে ফিরে চলে ভাড়াবাড়ির দিকে|
(২)
‘দিদি কিচ্ছু ভাববেন না আপনি‚ যেমনটা চান ঠিক তেমনটাই আমি করব| ‘ একটা মোলায়েম হাসি হেসে বলে অমিয়ভূষণ|
‘কিন্তু জমিটা তো আর আমার থাকবে না| পাঁচজনের হয়ে যাবে’ কঙ্কনা ইতঃস্তত করে|
‘আরে দিদি ঐভাবে কেন ভাবছেন বলুন তো| ধরুন আপনি যদি বানাতেন তাহলে দুটো ঘর‚ একটা ডাইনিং‚ কিচেন‚ বাথরুম একটা কিম্বা দুটো আর একটা ঠাকুরঘর| আর আমি আপনাকে কি দিচ্ছি দুটো টু বি এইচ কে ফ্ল্যাট মানে চারটে রুম‚ দুটো ডাইনিং‚ দুটো বাথরুম‚ দুটো কিচেন| কতটা বেশি বলুন তো| এবার বাকি ফ্ল্যাটগুলো তো ওপরে ওপরে হচ্ছে| আপনি নিজে করলেও তো অতগুলো ঘরে থাকতেন না| বন্ধ করে রাখতেন| লাভ কি তাতে? আর এই যে আমি আপনার জন্য ঘর বানিয়ে দেব‚ তা কিছু তো লাভ করব তাই না? আমি ঐ ফ্ল্যাটগুলো বিক্রি করে বাড়ি তৈরীর খরচ আমার লাভ তুলব| ‘
‘আর অলিন্দ?’
‘আরে হ্যাঁ হ্যাঁ ওটা তো হবেই| একটা অর্ধবৃত্তকার বারান্দা‚ আমার মনে আছে দিদি|’ আবার হাসে অমিয়ভূষণ| ‘আমি বলি কি দিদি‚ আমি এগ্রিমেন্টের কাগজ রেডি করি| তারপর পাওয়ার অব অ্যাটর্নি রেজিস্ট্রি করতে হবে, আরো অনেক কাজ| আপনি আর একটু ভেবে নিন| কিন্তু বেশি দেরী করবেন না| জানেন তো শুভস্য শীঘ্রম| ‘ বলে উঠে দাঁড়ায় অমিয়ভূষণ| দুহাত জোড় করে নমস্কার জানিয়ে বেড়িয়ে যায় ঘর ছেড়ে|
কঙ্কনার মনটা কিছুতেই সায় দেয় না| নিজের ঐ একচিলতে জমিটা অন্যের হয়ে যাবে এই ভাবনাটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়| কতগুলো বছর তো কেটে গেল তবু বাড়ি করার স্বপ্ন আজও স্বপ্নই থেকে গেল| অথচ দিন প্রতিদিন যে হারে বাড়ি তৈরীর জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে ব্যাঙ্কের আমানতের ওপর সুদের হাত তত কমছে| যে কটা টাকা আছে ব্যাঙ্কে তাতে ভিত দেওয়াটাই এখনকার বাজারে আর সম্ভবও নয়|
জামাই প্রীতম অমিয়ভূষণের খোঁজ এনেছিল| টুসির আর লেখাপড়া হবে না জানত| তাও বেশ কিছুদিন চেষ্টা করেছিল| তারপর প্রীতমের সাথে সম্বন্ধ করে বিয়েটা দিয়েছে কঙ্কনা| একটা কোম্পানীতে গ্রাফিক ডিজাইনের কাজ করে| মন্দ আয় নয়| মেয়েটাও সুখে আছে| কাছাকাছি থাকে| ইদানিং শরীর গতিকও ভালো যাচ্ছে না| তার ওপর দু দুবার বাড়ি পাল্টানো| প্রতিবছর ভাড়া বাড়ছে| সবকিছু নিয়ে বেশ নাজেহাল কঙ্কনা| কটা দিন বা আর বাঁচবে থেকে থেকে এই চিন্তা বড্ড বেশি মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়| প্রীতমকে বলেছিল একবার‚ ‘ দেখো না একটা ভালো প্রোমোটার| তাহলে শেষ জীবনটা আর এ বাড়ি ও বাড়ি করে বেড়াতে হয় না|’ মনোরমার কথাগুলো মনের মধ্যে গেঁথে গেছিল| আর সময়ের সাথে তাল রেখে এলাকার উন্নতি এখন অনেক বেশি| তার জমির সামনে দিয়ে চওড়া রাস্তা তৈরি হয়েছে‚ স্কুল-কলেজ‚দোকান হাটে এখন আর গন্ডগ্রাম কেউ বলবে না| জমির দাম এখন হু হু করে বাড়ছে| রাস্তা ঘাটের‚ যানবাহনের উন্নতির ফলেই বেশ কিছু জমিতে প্রোমোটিং ও হয়েছে|
প্রীতম জামাই হিসেবে বেশ কাজের| বেশিদিন অপেক্ষা করতে হয়নি| অমিয়ভূষণকে নিয়ে এসেছিল| বেশ কিছুদিন ধরেই কথাবার্তা চলছে| প্রাথমিকভাবে বেশ ভালো মনে হয় অমিয়ভূষণকে| কথাবার্তায় নম্র-ভদ্র-বিনয়ী| নাহ ভাবার আর কিছু নেই| ভাবতে ভাবতে তো একটা গোটা জীবন চলে গেল| দুটো দু বেডরুমের ফ্ল্যাট পেলে বেশ ভালো হবে| টুসিদের একটা দিয়ে দেব| তারপর তো চোখ বুজলে সবই ওদের| বয়স তো বাড়ছে প্রত্যেকটা দিন একটু একটু করে| যাবার আগে একটু সুখভোগ করে যেতে চায় সে ‚যেমনটা পুষ্কর দিতে চেয়েছিল তাকে|
করুক এগ্রিমেন্টের কাগজ রেডি| একবার মনোরমার ছোট ভাইকে দেখিয়ে নিয়ে সই করে দেবে| তারপর রেজিস্ট্রি করে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে দিলেই কাজ শুরু| শুভ্স্য শীগ্রম|
(৩)
আজ কঙ্কনার নতুন ফ্ল্যাটের গৃহপ্রবেশ| পাক্কা তিনটে বছর কেটে গেছে পৌনে দুকাঠার জমিতে ফ্ল্যাটটা হতে| অথচ এগ্রিমেন্টের সময় অমিয়ভূষণ বলেছিল‚ ‘দিদি‚ একবছরের মধ্যে আপনাকে পজেশন দিয়ে দেব|’ আশায় আশায় এক বছর দু বছরে আর দু বছর তিন বছরে গড়িয়ে গেছে| তাও যে পজেশন পেয়েছে এটাই অনেক| এই প্রোমোটারদের সম্পর্কে যত দুর্নাম শুনেছিল কঙ্কনা‚ বাস্তবে সব যে সত্যি সেটা তো নিজের চোখেই দেখল| মেটিরিয়াল মোটেই ভালো দেয়নি| দুটো বর্ষা পার হবে কিনা কে জানে| বেডরুমগুলো বেশ ছোট| যাকগে তবু তো একটা আস্তানা জুটল একদম নিজের|
অবশ্য শুধু তার নয়‚ আজ টুসির ফ্ল্যাটেও গৃহপ্রবেশ| এক খরচে দুই খরচ পুষিয়ে নেওয়া| বেশ কিছু আত্মীয়‚ মেয়ের শ্বশুরবাড়ি ‚ বাড়িওয়ালা যার বাড়িতে এখন তিনি ভাড়া আছেন আর পাড়া-প্রতিবেশী মিলিয়ে গোটা পঞ্চাশ জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে| একটা নারায়ণ পুজো দিয়ে তো ঢুকতেই হয়| রান্না বান্নার ব্যবস্থা কিছু করে নি| প্যাকেটের ব্যবস্থা আছে| সবার হাতে একটা একটা করে ধরিয়ে দেবে পুজো শেষে| এখন আর কি আগের মত শরীর আছে যে খাটবে‚ না হলে একা হাতেই পঞ্চাশজনের রান্না করাটা কোন ব্যাপার ছিল না| তার ওপর টুসির মেয়েটাও হয়েছে ডানপিটে| কে বলবে তিনবছর বয়েস| এটা ভাঙছে‚ ওটা ফেলছে| এখানে উঠছে‚ ওখানে চড়ছে| সবসময় চোখে চোখে না রাখলেই বিপদ|
সবচেয়ে প্রিয় একটা জায়গা সে ‚ সেই কোনকাল থেকে আশা করে বসেছিল ‘একটা অলিন্দ’‚ কিন্তু সেটা তেমন মনের মত হয় নি| অর্ধবৃত্তাকার‚ লাল মেঝে তো হয়নি| মার্বেলের ফ্লোর‚ আর একচিলতে একটা বারান্দা‚ ওটাকে ঠিক অলিন্দ বলা চলে না| অলিন্দ মানে প্রাণের মুক্তি‚ অলিন্দ মানে একটুকরো খোলা আকাশ‚ অলিন্দ মানে দুপুর রোদে লুটোপুটি‚ অলিন্দ মানে ছোটবেলার পুতুলখেলা| একটা একমানুষ সরু জায়গা| না ওখানে পুতুল খেলা যাবে‚ না যাবে আকাশটাকে ভালোভাবে দেখা| সন্ধ্যের অবসরে বসা হবে না ধুমায়িত চায়ের কাপ নিয়ে সেই যেমনটা পুষ্কর বলত‚ ‘ বুঝলে কণা‚ অবসরের পর দুটো চেয়ার পেতে মুখোমুখি বসব দুজনে সন্ধ্যের অবসরে| ‘আজ বড্ড পুষ্করের কথা মনে পড়ছে| বারে বারে চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে|
‘মা ঝুমিকে দেখো| দেখো যেন আবার বারান্দায় না চলে যায়’ বলে টুসি মেয়ে ঝুমিকে রেখে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের সামলাতে চলে যায়|
বড্ড ছটফটে হয়েছে নাতনীটা| কিছুতেই কোথাও চেপে বসাতে পারবে না| বসালেই এমন চেঁচাবে যে লোকে ভাববে কেউ মেরেছে বুঝি| টুসি কিন্তু এত দুষ্টু ছিল না| ফ্ল্যাটটাতে এখনো জিনিসপত্র সব আনা হয়নি ভাড়াবাড়ি থেকে| টলমল পায়ে হাঁটে ঝুমি| পিছু পিছু ঘোরে কঙ্কনাও| ঐ দিকের দেওয়ালে পুষ্করের একটা বড়ো ফটো বাঁধিয়ে লাগাবে| আর ঐ যে বারান্দা ওখানে একটা মানি প্ল্যান্ট| ভাবতে ভাবতে একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিল কঙ্কনা| সেই ফাঁকেই ঝুমি পা বেয়ে বেয়ে কখন যে বারান্দার গ্রিলটায় উঠেছে খেয়াল করতে পারেনি সে| হঠাৎ চোখ পড়তেই বুকের ভেতরটা হিম হয়ে যায় কঙ্কনার| বারান্দার ওপরটা কভার করা নয়| খোলা বারান্দাই তো রাখতে চেয়েছিল কঙ্কনা| ওপরটা কভার করলে যে পুরো জেলখানা মনে হবে‚ শ্বাস নিতে কষ্ট হবে| আর টুসি বলেছিল কভার করে নিতে ঝুমির কথা ভেবেই| ঝুমি তো বেশিরভাগ সময়টা কঙ্কনার কাছেই থাকে|
দৌড়ে যায় কঙ্কনা| ঝুমি ততক্ষণে একদম প্রায় শেষ প্রান্তে পৌঁছে গেছে| ‘ঝুমি দাঁড়া দাঁড়া‚ আর উঠিস না| ‘ ঝুমি খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে| দিদুর এত ভয় কিসের কে জানে?দিদুর দিকে আরেকবার একটা ভীষণ দুষ্টু চাউনি দিয়ে, সে সামনে তাকায়| দিদুর সাধের অলিন্দ তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে|সে এগোতে থাকে…
ছবি : সৌম্যদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
Facebook Comments