ভৈরবী
ঘুম থেকে চোখ মেললেই জানলা দিয়ে নিমগাছে কাকের বাসাটা দেখতে পায় জিনি । ছোট্ট ছোট্ট ছানা, মুখের ভিতরটা কেমন লাল লাল, মায়ের চারপাশে কলবল করছে খাবার জন্য। ঘুমচোখ জলে ভরে গেল জিনির। মা কতদিন তাকে খাইয়ে দেয়না! ভাল করেই কথাই বলেনা। কি দোষ করেছে সে! বুকের মধ্যে ভাবলেই মুচড়ে ওঠে।
এজমালি বাড়িতে তাদের ভাগে কুল্যে দেড়খানা ঘর। শোয়া, বসা, পড়ার ঘর এই একটাই। পাশের হাফ ঘরে রান্নাবাড়া খাওয়াদাওয়া হয়। তাদের লাভ বলতে একচিলতে বারান্দাটুকু । জিনির বড় প্রিয় জায়গা। ওইখানকার দেওয়ালে অনেক ভালবাসার ছোপ লেগে আছে। চারিদিকে তাকিয়ে মাকে কোথাও দেখতে পেলনা জিনি। রান্নাঘরও বন্ধ। বিছানা থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে রেলিং এ হাত রেখে দাঁড়াল জিনি।নীল আকাশটা ঝকমক করছে সকালের আলোয়। সামনের মাঠে পাড়ার প্যান্ডেল প্রায় শেষের মুখে। বারান্দা থেকে হাত বাড়ালেই দুএকটা শিউলিফুল তুলতে পারত জিনি, বাবা কত তুলে দিত! ইচ্ছে করল না আর। ঘরে ফিরে এসে বিছানায় আবার ধপ করে শুয়ে পড়ল মেয়েটা। কেমন যেন বিস্বাদ সব, বড় বেরঙ, বড় ফিকে তার তের বছরের জীবন।
পাশের ঘর থেকে পিসিঠাম্মার ঘর থেকে বাসনের আওয়াজ আসছে। ঠাম্মা আর পিসিঠাম্মা একসাথে থাকত। ঠাম্মা চলে গেল গত শীতে, পিসিঠাম্মা আছে বটে না থাকার মত করে। তবু তো সে আছে বলে এখনো খিদের দুপুরে দুটো ভাত পায় জিনি। মা তো অর্ধেকদিন সকালে উঠেই চলে যায় তপনকাকুর বাড়ি, তাকে রান্না করে দেয়, ওখানেই খায়, ফিরতে ফিরতে সন্ধে।
জিনির নিজের কাকু একতলায় থাকে কাকিমার সাথে। বাবা আর কাকু পুরো বিপরীত স্বভাবের। বাবা যেমন শান্ত আর নম্র ছিল, কাকু তেমনই মারকুটে আর ঝগড়াটে। একতলায় কাকু মাকে গালাগালি করে, শুনতে পায় জিনি । সব ভাষা বোঝেনা জিনি, ভাবটুকু বোঝে। এও বোঝে কাকু যা বলে প্রায় সব ঠিক, তবু মাকে ওইসব বললে খুব কষ্ট হয় তার, রাগ হয়। কাকিমাকেও খুব গালাগালি করে কাকু, সেটাতে আরও রাগ হয় জিনির, কারণ সেগুলো মিথ্যে। বলে কাকিমা নাকি লোভী, মেয়েমাত্রই নাকি লোভী হয়, কাকিমা নাকি দুদিন পর মায়ের পথ ধরবে, ঘরের খেয়ে কাকিমার আশ মেটেনা, এর ওর থেকে চেয়ে খেয়ে খেয়ে মোটা হচ্ছে।
আচ্ছা, কাকু তার বাবার মত ট্রেনে কাটা পড়ে মরেছে ? কাকুকে কি তপনকাকুর মত কেউ বাবার মত ঠকিয়ে পুরো ব্যবসা নিজের নামে করে নিয়েছে? বাবা থাকতে কি মা এমন ছিল নাকি? তবে কাকু থাকতে কাকিমা কি করে মায়ের মত হয়ে যাবে? কাকিমা এমনিই একটু মোটাসোটা। তাবলে মোটেই লুকিয়ে পিসিঠাম্মার ঘরে এসে খায়না, পাড়ার কারুর থেকে চেয়েও নয়। আজকাল খুব কম স্কুলে যায় জিনি, এমন হলে সে জানত ।
বই নিয়ে বসার বৃথা চেষ্টা করতে লাগল জিনি। পড়াগুলো সব যেন অচেনা। মা আজকাল কিচ্ছু দেখেনা জিনির। স্কুলে পড়া পারত না আর তেমন জিনি। বাবা থাকতে কত আদর করে পড়াত তাকে, সবকিছুতে এ গ্রেড পেত সে । সুপ্রভা ম্যাম খুব ভালবাসতেন জিনিকে। জিনির ভাল নাম কৌশিকী। ম্যামই বলেছিলেন কৌশিকী হল মা দুর্গার এক নাম। ম্যাম মাকে ডেকেছিলেন , বললেন যে জিনি আগের মত পড়া পারেনা, এও বললেন যে জিনির গানের গলা খুব ভাল, মা পাত্তাই দিল না । কেন জিনি জানে। আসলে মা তো আর বেশিদিন থাকবেনা তার সাথে, সে জানে। নতুন ফ্ল্যাট তৈরি হচ্ছে পাড়ার মোড়ে, ওখানেই ফ্ল্যাট কিনছে তপনকাকু, শেষ হলেই মাকে নিয়ে ওইখানে উঠে যাবে ।তাকে সাথে নেবেনা মা, তাও জানে জিনি।
ভয় করে তার। ভীষণ ভয়। তপনকাকুকে ভাল্লাগেনা তার, তবু মা তো থাকত! মা চলে গেলে কার সাথে থাকবে সে! পিসি ঠাম্মার কাছে দুপুরবেলায় খেতে বসে সব শুনেছে সে। মা নাকি পিসিঠাম্মাকে বলেছে তাকে দেখতে। ঠাম্মা কি অতশত পারে ! বাবার কথা বড্ড মনে পড়ে একা জিনির। কি সুন্দর প্রজাপতির মত দিন ছিল। লুচি আলুরদম বানিয়ে চিড়িয়াখানায় যেত সে বাবামার সাথে, বাবা আর সে ছোট্ট বারান্দায় টবে গাছ লাগাত। দিনগুলো যেন প্রজাপতির মতই কোথায় উড়ে গেল ডানা মেলে ।
দেখতে দেখতে রাত হয়ে আসে। মা বোধহয় আজ আর বাড়িই ফিরবেনা। খুব ভয় করে তার। বাবার ছবিটার দিকে তাকিয়ে হুহু করে কাঁদে। ভাবে পিসিঠাম্মার ঘরে গিয়ে শোবে। জানে এখন ঠাম্মা গভীর ঘুমে, ওষুধ খায় তো! ডাকবে ভাবে একবার, পারেনা, কেমন বাধে, সে তো বড় হয়েছে । খাটে বসে দুহাঁটু জড়ো করে বসে একদৃষ্টে আলোর দিকে তাকিয়ে থাকে সে।
কটা বাজে, আর দেখছিল না জিনি। টের পায়, কাকু ফিরল নিচে। মেন গেটের কোলাপ্সিবল গেট বন্ধ করার আওয়াজ আসে তার কানে। আজ তার প্রথম একা রাত। আবার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায় জিনি। শিউলির গন্ধে মাতোয়ারা বারান্দাটা। চারিদিকে সব আলো নিবে গেছে, কিছুদূরে তপনকাকুর ভাড়ার ঘরেও। কষ্ট, ভয়টা কেমন রাগে পরিণত হতে থাকে ওর মধ্যে। তীব্র রাগ। সব ধ্বংস করে দেবার রাগ, যা আগে কখনো হয়নি ওর।
পাড়ার রাস্তায় আলো লাগানো শুরু হয়েছে। কাল মহালয়া। বাবা এইদিন বলত – কাল মা আসবেন। ভোরে তুলে রেডিও চালিয়ে মহালয়ার অনুষ্ঠান শোনাত। এবার ঠাকুরের মুখ দেখবেনা ঠিক করে ফেলে জিনি। কোন মা চাইনা তার, সে একাই লড়বে এবার, দেখা যাক কতদূর লড়া যায়।
টয়লেট পাচ্ছিল জিনির। অদ্ভুত ভাবে ভয়টা আর টের পাচ্ছিল না ও। সিঁড়ির জমাট অন্ধকার হাতড়ে নিচে নেমে গেল। নামতেই সেই আওয়াজ, যা ও আগে বহুবার শুনেছে…. কাকুর গালাগালি আর গর্জনের সাথে মিশে যাওয়া কাকিমার চাপা চিৎকার আর কান্না। কাকিমার কাছে যাওয়ার হুকুম ছিলনা জিনির কখনওই। বাবা চলে যাওয়ার পর কাকু একদিনের জন্য মুখ দেখেনি জিনি বা তার মায়ের। দাদার মৃত্যুর জন্য মাকেই দায়ী করত কাকু, কিন্তু জিনি কখনওই বুঝতে পারেনি তার দোষটা কোথায়। আজ কাকিমাকে ঠিক যেন নিজের মতই অসহায় লাগছিল জিনির।
কাকিমার কান্নার আওয়াজ ক্রমশঃ আর্তনাদ হয়ে উঠছিল। টয়লেট থেকে ফিরে আবার চুপচাপ সিঁড়িতে পা রাখছিল জিনি, হঠাৎ কাকিমা খুব জোরে কঁকিয়ে কেঁদে উঠল । আর পারল না জিনি, ফিরল । অসম্ভব রাগ হচ্ছিল তার, অসংযত আর অবাধ্য রাগ। কাকিমাদের ঘরের দরজায় অসভ্যের মত ধাক্কা দিতে থাকল সে। তার হাতের ঘায়ে পর্দা টাঙানোর রডটা ক্ল্যাম্প থেকে খুলে নেমে এল, খসে পড়ে গেল পর্দাটা । হাতে রডটা শক্ত করে ধরে আলুথালু বেশে দরজা খোলা হতভম্ব কাকুকে পিছনে ফেলে এগিয়ে গেল খাটের দিকে, যেখানে কাকিমা শুধু একটা আধখোলা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে চুল খুলে কেমন ছোট্ট মেয়ের মত জিনির দিকে দুহাত বাড়িয়ে রেখেছে।
তারপর যে কিকি হয়েছিল, নিজেই ঠিক বলতে পারবে না জিনি। কাকুর মত শক্তিশালী মানুষ বাধা দিল, আর সে সেই প্রতিরোধ ঠেকিয়ে ওই সরু অন্ধকার সিঁড়ি বেয়ে কাকিমাকে নিয়ে উপরে নিজের ঘরে এল…. সে কি আর তবে জিনি নেই! সে কি তবে অন্য কেউ হয়ে গেছিল ওই সময়টুকুতে! একপাহাড় অবাক পেরিয়ে জিনির মনটা বহুদিন পর যেন বড্ড ভাল লাগছিল। সে পেরেছে, একদিন যখন পেরেছে, রোজ সে পারবে। তার ছোট্ট কোলে মুখ রেখে বহুদিনের কান্না কাঁদছিল কাকিমা । জিনির হাত তার মাথায়, মুখে হাসি আর চোখে জল। মা দুগগার মুখটা দেখতে হঠাৎ খুব ইচ্ছে করছিল জিনির ।
শিউলির গন্ধটা ঘরে ঢুকে ঘিরে ধরেছিল ওদের। রাতের চুমকিতারাগুলো একে একে ডুবে যাচ্ছিল নতুন সূর্যের মখমলি আলোর গালিচায়। কোথাও দূরে বাজছিল –
অহং ধনুরাতনোমি ব্রহ্মদ্বিষে শরবে হন্তবা উ
অহং জনায় সমদং কৃণোম্যহং
দ্যাবাপৃথিবী আ বিবেশ ।।
অলংকরণ : সমীরণ মন্ডল
Facebook Comments