শিবদুগ্গার আধার কার্ড
ওগো শুনছ? এবার তোমাদের সকলের মর্ত্যে যাওয়াটা নাকি খুব চাপের, তোমরা বরং যেও নি বাপু । শিবু দা বলে বসলেন।
দুগ্গা বৌদি শশব্যস্তে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে বললেন, আবার সেই এক কথা, প্রতিবারের মত। আমাদের যাওয়া টা ভেস্তে না দিলে মিন্সের নেশাটা ঠিক জমছে না। বলি কি হল বাপু? তোমার সব ব্যাবস্থা তো করে দিয়েই রওনা দি প্রতিবার। গুছিয়ে সব বোর্ডে লিখে দিয়ে , নন্দীকে বলে দিয়ে তবে ই তো যাই।
শিবু দা বললেন, আরে, আমার জন্য বলছি না গো। এবার সেখানে অনেক নিয়ম হয়েছে। এদ্দিন তো বিনা পাসপোর্ট, ভিসায় দিব্যি স্বর্গ থেকে মর্ত্য অবধি অবাধে যাতায়াত করা যেত। এখন তো কি যেন “আধার” না কি সব বাধ্যতামূলক হয়েছে।
দুগ্গাবৌদি উন্মুক্ত কেশরাজি কে ন্যায়দম খাইয়ে মাথার ওপরে সু উচ্চে এক টপ নট বেঁধে নিয়ে বললেন, কি? দিনদুপুরে আঁধার কোথায় দেখছো গো? ওরে গণশা, কেতো তোদের বাপের কি ভীমরতি হল না কি রে?
শিবু দা বললেন, দেখো আমি মাতাল হতে পারি তবে তাল দি ঠিক কিন্তু। তোমরা কোনো খবর রাখো না। এই শরতের সোনাগলা রোদ্দুরে আঁধার হতে যাবে কোন দুঃখে ? আমি তো আ-আ-ধার এর কথা বলছিলাম।
দুগ্গাবৌদি বললেন, বাপেরবাড়ি যাব বলে এখন অত “রাঁধার’ সময় নেই আমার। এ কটা দিন ঐ যা হবে তাই খাবে, এই বলে দিলুম। শিবু দা বললেন, আমি কি ছাই অত ভোজনরসিক? সে তো তোমার গণশার জন্যে রাঁধাবাড়া। আমার একটু ফলের রস, মাখন মিছরি জুটলেই হল। তুমি আমার কথাটাই বুঝছ না। রাঁধার কথা কে বলছে তোমায়?
দুগ্গা বললেন, তবে কি গো? এই বয়সে চুল বাঁধার কথা বলছ? সারাটাজীবন চুল বাঁধতে দিল নি, বললে, দুগ্গা, তোমায় হেব্বি সেক্সি লাগে, পায়ে পড়ি তোমার অমন চুলগুলি বেঁধে রেখোনি আর এই এখন তিন কাল গিয়ে এককালে ঠেকতে বলছ কি না চুল বাঁধতে? এই তো বেঁধেছি যেমন তেমন করে । ওত কায়দা করে আমার এখন চুল বাঁধার সময় নেই।
শিবু দা এবার তারস্বরে বললেন, ও রে বাবা, কে তোমায় চুল বাঁধতে বলেছে সুন্দরী? আমি যা বলছি তুমি এখনো বুঝলে না। আমি আ-আ-ধার এর কথা বলছিলাম।
মুচকি হেসে শিবু দার গা ঘেঁষে দুগ্গাবৌদি বললেন, যাও যাও ঢের হয়েছে। আর হাঁদার মত তাকিয়ে থেকো না। কি আবদার করবে বলো? পাবে না, পাবে না তুমি আমাকে এখুনি পাবে না। হাতে গুচ্ছের কাজ আমার। তোমার আফগারী বিলাসের জন্য আবদার সুয্যিডোবার বেলায় হবে, এই বলে দিলুম, এই ভর দুপুরে নয়। এ বেলা কি আহারের আবদার শুনি? বলি হেঁশেলের গ্যাস ওভেন টা বিপ্ বিপ্ শব্দ করছে কাল থেকে। আজ আহার হবে হরি-মটর।
উঁহু! ওসব বিপ বিপ মুখেও এনো নি । ঝামেলি বাড়বে বই কমবে নি । তবে জেনে রেখো আহারের কথা বা কোনো আবদারের কথাও আমি বলিনি তোমায়। আমি বলেছি আ-আ-আ-আ-ধার ।
দুগ্গা বৌদি বললেন, এখন আ-আ-আ করে সরোর মত গলা সাধার কোনো ইচ্ছে হয় নি আমার। ব্লাউজ গুলো পড়ে আছে দর্জ্জির দোকানে। গতবারে প্রণামীর ভ্যানিটি বাক্সের সব দামী নোটগুলো অচল। কোনোটা নেবে না বলেছে সে। শিবুদা বললেন, তুমি জানতে না? তোমরা ফিরে আসবার পরেই মর্ত্যে হয়েছে নোটবন্দী?
দুগ্গা বললেন, মর্ত্যে কি ফন্দী হল আবার?
আরে ফন্দী না বন্দী।
এর মাঝে আবার নন্দী কে টান কেন?
নন্দী আসবে কেন? ডি-মনিটাইজেশন হয়েছে, সে খবর রাখো তুমি?
হ্যাঁ, ইমিউনাইজেশন তো গতবারেই করিয়েছিলাম প্রত্যেকেই আমরা। টিকে নিয়ে সেই কি জ্বর এল লখ্যুটার, মনে নেই?
গায়ে তেল মেখে দিব্যি করে সেই তেলের হাতটা নিজের কাপড়ে মুছতে মুছতে দুগ্গাবৌদি যেন দিশেহারা। একদিকে প্যাকিং অন্যদিকে বিউটি ট্রিটমেন্ট। ছেলেপুলেদের জিনিষপত্র তো আছেই। সেই সঙ্গে একগন্ডা পোষ্য।তাদের জন্য ব্যাবস্থা । কোথায় পেঁচার খাঁচা, ইঁদুরের সিঁদুর রঙের কাপড়ের ব্যাগ, সারাটা পথ তার দাঁত শুলোবে, সে কাটতে কাটতে যাবে তাই। হাঁসের জন্য পলিথিনের ফোলানো বাথটব, যাতে জলে বসে বসে সে থ্যাপ থ্যাপ করতে করতে মনের সুখে যেতে পারে। আর ময়ূরের জন্য সাপের ঝুড়ি । আমার সিংহটার কোনো জ্বালা নেই। সে এখন আর গোমাংস খায়না। সম্পূর্ণ নিরামিষাশী। নয়ত গতবার অবধিও কয়েকটা বাছুর নিয়ে যেতে হত সঙ্গে। তাই বাঁচোয়া।
শিবুদা এক ছিলিম গঞ্জিকা নিয়ে আবার সুখটান দিলেন। পাশের ঘর থেকে কেতো এতক্ষণ সব শুনছিল। গঞ্জিকার ঘ্রাণে মনে মনে ভাবল যাক বাবা, বাবা-মায়ের আধার-পর্বে বিরতি হল বুঝি। কিন্তু ভবি ভোলবার নয়। গঞ্জিকা সেবন করতেই শিবুদার জটাজুটো সহ মাথাটা আবার খুলে গেল। বেশ জমে উঠেছে গিন্নী তথা অর্ধাঙ্গিনীর সঙ্গে মশকরা। তুমি তাহলে আধার এর জন্য একটুও সময় দেবে না?
দুগ্গাবৌদি বললেন, আজ্ঞে না, আমার এখন একটুও কাঁদার সময় নেই।
কে বলেছে তোমায় কাঁদতে গিরিনন্দিনী?
তুমিই তো বললে এইমাত্র।
আমি তোমায় অন্য কথা বলেছি মাত্র।
আমার ওপরে একহাত তুমি নিচ্ছ কেবলি অহোরাত্র।
দুগ্গাবৌদি বললেন, থাক্ ! আর বুড়ো বয়সে কোব্তে করতে হবেনা।
আরে, আরে কোব্তে করব কেন?
আমার কিবা দিন, কিবা আঁধার? সব জুড়েই তুমি আমার!
মত যাও ইধার্, উধর, পহেলে দিখাও তুমহারা আধার
আর আজ তুমকো বুঝিয়েই ছাড়ুঙ্গি কাকে বলে এই আ-আ-ধা-র !
দুগ্গাবৌদি এবার বল্লেন, বাপ্রে বাপ্!! কোব্তের বান ডেকেছে আজ!
শিবুদা বললেন, এমনি যখন শুনছ নি তখন কোবতে করেই ছাড়ুঙ্গি।
কি বললে লুঙ্গি? তুমি তো পরোনি আজ অবধি কখনো। বাঘ ছালেই তো তুমি বলো বেশ ভালো লাগে। এখন আবার লুঙ্গি পরবে বলছ কেনো গো? ওগো আমার একি হল? ওরে কেতো, গণশা, সরো, লখ্যু, তোদের বাবা বোধহয় সেক্যু হয়েছে রে।
গণশা এসে অমনি বললো, ওমা জানোনা বুঝি? বাবার দেখাদেখি সিংহটাও তো তাই মাংস ছেড়েছে। তুমিই শুধু বদলালে না।
শিবুদা হা হা করে হেসে বললেন, লুঙ্গিই পরতে হবে এবার, নয়ত বন্যপ্রণী সংরক্ষণের মামলায় জড়িয়ে পড়তে হবে। তবে সবকিছুর আগে চাই আ-আ-ধা-র ।
না, না তুমি কিনা তুমি কিনা জগতের ঈশ্বর, মহেশ্বর তুমি আবার ধার করতে যাবে কেন? আমিই না হয় প্রণামীর বাক্স ঝেড়েঝুড়ে তোমার জন্য লুঙ্গি কিনে আনব এবার, লুঙ্গি শুনেছই খুব সস্তা সেখানে ।
আগে তো পৌঁছাও সেখানে, তারপর কেনাকাটি। তবে এধার ওধার, টাকা ধার, সর্বাগ্রে চাই আধার। শিবুদার বক্রোক্তি। এঁকে নোটবন্দী তায় আবার জিএসটি। লুঙ্গিও আর সস্তা নেই গো। সেখানে মেয়েদের নাইটি আর ছেলেদের লুঙ্গি হল জাতীয় পোশাক। তাই দাম বাড়িয়েছে সরকার।
কেতো এসে হঠাত উপস্থিত সেখানে। বাপ-মায়ের তরজায় সাধারণতঃ কান দেবার সময় নেই তার তবুও আধার প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেল না সে। বাবা, মায়ের কান টা একবার দেখাতে হবে। ধন্বন্তরী জ্যেঠু সেবার বলেছিলেন শ্রবণেন্দ্রিয় বিশারদকে দেখিয়ে নিতে। মা কথাটা কানেই নিল না। মর্ত্যে গিয়ে নানারকমের কানযন্ত্র পরে এলেই ঠিক শুনতে পেত সব। মা বলল ওসব পরবে না। উনি নাকি দিব্য শুনতে পান। এখন বুঝতে পারছি কতটা এগিয়ে এসেছে মায়ের বধিরত্ব। তোমার একটা কথাও মা ঠিকঠাক শোনেনি এতক্ষণ। সরো এসে বলল, আর মায়ের দোষ দিই বা কি করে? মর্ত্যে গিয়ে প্রতিবার শব্দদূষণে আমাদের সকলেরি কর্ণপটহ ফেটে যাওয়ার উপক্রম হয়। আর লখ্যু বেশ অভিযোগের সুরে জানাল তার মনের ব্যাথা। আমি তো সেই কবে থেকেই বাপু নীরবতা পছন্দ করি। তা না মর্ত্যবাসীরা আমাদের জ্বালিয়ে পুড়িয়ে খায় ক’টা দিন। ঢাক-শাঁখ-কাঁসর-ঘন্টা তেই তৃপ্ত থাক না বাপু। গণশা অমনি শুঁড় দুলিয়ে, ভুঁড়ি নাচাতে নাচাতে বলল, তবে যাই বলো বাপু, যা সব মুখরোচক মিষ্টান্ন খাওয়া হয় মর্ত্যে গেলে তাতে ঐ শব্দ দূষণ টুশণ এমন কি সাতখুন মাপ করে দেওয়া যায়। কেতো বলল, আর মায়ের কানদুটোর যে বারোটা বেজে গেল, সেই বেলা? গণশা বলল, অর্ডার দাও কানযন্ত্রের। অত গয়নার মাঝে আরেকটা গয়না পরে নিক মা।
শিবুদা বললেন, ঠিক এইটাই ভাবছিলাম
নয়ত তোদের মা আ-আ-ধার কার্ডের ব্যাপরটা কে তিল থেকে তাল করে ফেলল? আধার প্রসঙ্গ থেকে চুল বাঁধার, রাঁধার, গলা সাধার, কাঁদার, এধার ওধার ধারদেনা, নোটবন্দী, নন্দী আর সবশেষে কিনা লুঙ্গি প্রসঙ্গ নিয়ে আমাকে বিলকুল সেক্যুলার বানিয়েই ছাড়ল?
ওদিকে চাঁদার জুলুম নিয়ে কারা যেন আর্জি পেশ করেছে আমার কাছে। তারাই খবর দিয়েছে, এবার যাবার আগে আধার করাতেই হবে সকলকে। তাই বলেছি আমি । আর তোদের মা আমাকে হাঁদার মত তাকিয়ে থেকোনা পর্যন্ত বলল। আমি তো বাপু সারাদিন ছাইয়ের গাদার ওপর বসে থাকি। তোমরা যা ছাঁদার মধ্যে থেকে খুলে দাও তাই খাই। আমি যে সবার গড ফাদার তাই ভুলে যাও সকলে।
কৈ তোমাদের পরম পূজনীয়া মাদার এবার কি উত্তর দেবেন দিন? তবে আধার না থাকলে খুব মুশকিল এবার তোমাদের। এই বলে দিলুম কিন্তু।
তোমার এই ধাঁধার উত্তর আমার জানা নেই কো। বুঝলে মিনসে? তোমার মত হেঁয়ালি ফাঁদার সময়ও নেই আমার। আর যুগ নেই কালো-সাদার। তোমার ঝোলাঝুলি ঝেড়ে এবার রঙ্গীন জোকস বের করো দিকিনি। দুগ্গাবৌদি নিজের জ্বালা জুড়োলেন।
অলংকরণ : দিব্যেন্দু সিংহ রায়
Facebook Comments