কি খবর
কুলকুল শব্দে বর্ষার জলে তাজা ছড়া বয়ে চলে ঝর্নার মতো। এসব ছোট জলধারাকে বলে ছড়া। খাওয়ার, রান্নার জল সরাসরি ছড়া থেকে নেওয়া হয় না। পাশের বালিয়াড়ী বা মাটি খুঁড়ে বাঁশের চোঙ ভরে বয়ে নিয়ে যেতে হয়। বাসন মাজা কাপড় কাঁচা সব ছড়ার জলেই হয়। অবশ্য ঘরে একটা মাটির কলসী আছে, বিশ্ঙ্গখলা হাট থেকে কেনা। যত্ন করে রাখা আছে বাঁশের ছোট মাচায়। চোঙের জল ভরে রাখা হয়। কাঁখে করে টিলা ভেঙে যাওয়ার সময় সঙ্গে নেয় না। যদি ভেঙে যায়। দামী জিনিস।
মহাত্মাগান্ধী জমাতিয়া খুব সাবধানী মানুষ। সাবধানে টংঘরের সামনেটা পরিষ্কার করছেন। জোঁক আছে, সাপও। বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো নাচে গায়, খেলা করে সবই; উঠোন পরিষ্কার না করলে চলে না। টাক্কল দিয়ে খুম্পুইফুলের ঝাড়টা ছেঁটেছুটে ঠিক করলেন। বর্ষায় সুগন্ধী, সাদা ফুলে ভরে আছে। সাপ আস্তানা করতেও পারে। সুচিত্রাসেন এসে দু’টো ফুল ছিঁড়ে খোঁপায় পরলো। না না, টালিগঞ্জের সুচিত্রা নয়; সুচিত্রার মা বুধলক্ষী তেলিয়ামুড়া সিনেমা হলে শাপমোচন দেখে সুচিত্রা সেনকে ভুলতে পারেনি। সুচিত্রার শ্বশুরমশাই যেমন অল্পদিনের উমাকান্ত বোর্ডিংবাসের সময় শচীনদা সুখময়দার কাছে শোনা গান্ধীবাবার কথা শুনে ছেলের নাম রেখেছিলে মাহাত্মাগান্ধী।
সুচিত্রা খুব শৌখিন। হাতের তাঁতে বোনা পরিচ্ছন্ন রিয়া পাছড়াতে তাকে পরীর মত দেখায়। খোঁপায় ফুল দিতে সে ভোলে না। তেলিয়ামুড়া শহরে হস্টেলে থেকে ক্লাস এইট অবধি পড়েছে। এখনও কোথাও একটা উল্টোরথ কি অন্য বই হাতে এলে কড়ই গাছের ছায়ায় বসে পড়তে ভালবাসে। দু’টো ছাপা শাড়ি বাবা দিয়েছিলেন। সব তোলা আছে হাতে বোনা বাঁশের সুদৃশ্য ঝুড়িতে। কখনো সখনো শহরে সিনেমা দেখতে গেলে পরে যায়। সুচিত্রার খুব স্বপ্ন ছিল লেখাপড়া শিখে দিদিমনি হবে, ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লিখে অঙ্ক শেখাবে – একঘর ছাত্রছাত্রী মন দিয়ে পড়া শুনবে। দু’চারটে দুষ্টু মেয়ে মাথায় মাথা ঠেকিয়ে গল্প করবে, দু’চারটি ছেলে ক্লাস পালাবে। তা পালাক।
সুচিত্রা তার মেয়ের নাম রেখেছে বন্দনা। ঐ দিদিমনিই স্কুলে পড়তে ওর সবচেয়ে প্রিয় ছিলেন। বকতেন না, ত-কে ট উচ্চারণ করে বলে মুখ টিপে হাসতেন না। নারায়ণ স্যার হঠাৎ অপ্রাসঙ্গিক ভাবে একঘর ছেলেমেয়ের সামনে ‘কিতারে চুংগাগুতানি খাইছসনি’ বলে অপ্রস্তুত করতেন। খারাপ লাগতো। সুচিত্রা বা তার মতো আদিবাসী বালক বালিকারা বুঝতো না, ওদের মা মাসীরা এত যত্ন করে বাঁশের চোঙে বুনো খরগোশের মাংস বা শুঁটকিমাছ ভরে নিয়ে তার সঙ্গে নানা রকম ভেষজ দিয়ে আগুনে পুড়িয়ে যে সুখাদ্যটি বানায় তা নিয়ে এত বিদ্রূপ করার কি আছে। তবু নারায়ণ স্যারই ইংরেজী গ্রামারটা যত্ন করে পড়াতেন। ভুলগুলো হেসে হেসে ধরিয়ে দিতেন।
সন্ধ্যেবেলা সুচিত্রা বন্দনাকে নিয়ে গান করে – ফিরগই ফাইখা – আবার ফিরে এসেছে বসন্তকাল – যদিও এখন হেমন্তের শেষ। চংপ্রেন বাজিয়ে জুম থেকে পোকা তাড়ায়, গান গায় মশাল জ্বালিয়ে পাহাড়ের মানুষ। দশজন বারোজনের দল পালা করে একএকদিন যায়। আজ মহাত্মাগান্ধী টাউনে গেছে। কিছু কেনাকাটা আছে। আর টাউনে তার বন্ধু যুগল সাহার দোকান আছে, একটু আড্ডাও হবে। এই সুযোগে মেয়েকে তেলিয়ামুড়া গার্লস স্কুলের হোস্টেলে সন্ধ্যায় গাওয়া সেই প্রেয়ারের গান আগুনের পরশমনি ছোঁয়াও প্রাণে – বন্দনা রিনরিনে গলায় ভালোই গায়।
সুচিত্রা ফিরে যায় তার স্বল্পদৈর্ঘ্যের স্কুলজীবনে। বাবা দুর্গাজয় তাকে সঙ্গে করে নিয়ে গেছিল স্কুলে ভর্তি করতে। স্কুল ফ্রী, হোস্টেলও ফ্রী। না হলে গরীব জুমিয়া বাবা মেয়েকে বোর্ডিংএ রেখে পড়ানোর সাহস কি করতে পারতেন। ওখানে বাঙালী লুসাই ত্রিপুরী সব একসঙ্গে থাকে। সন্ধ্যার আগে একসঙ্গে স্কুলের পুকুরে হাত পা ধুয়ে গান গেয়ে প্রেয়ার করে। একসঙ্গে খায়, গল্প করে। আদিবাসী গোষ্ঠীর মেয়েরা ছুটির দিনে দুপুরে কোমর তাঁতে রিয়া পাছড়া বোনে। কত রঙ কত নক্সা। সব নক্সা ওলটপালট হয়ে গেল আশির জুনে। সুচিত্রার মা বুধলক্ষীর বইনারী ছিল শহরে অধীরবাবুর বউ। অধীরবাবু বিডিও অফিসের কেরাণী। তখন পাহাড়ের গিন্নীরা শহরে গিয়ে বাঙালী গিন্নীদের সঙ্গে সই পাতাতো। বোনের মত ভাব ভালবাসা তাই বইনারী। ঝুড়িভরা পাহাড়ী আলু, সব্জী পিঠে নিয়ে শহরে যেত মায়েরা কয় বন্ধু – শহরে কারো বাড়িতে ঢুকে – তখন কারো সদর দরজা বন্ধ হতো না দিনের বেলা, সবার জন্যই অবারিত দ্বার – বইনারী পাততনি? – ডাক দিতো। উত্তরে সাড়া দিয়ে বেরিয়ে আসতেন ঘরের ঘরণী। রঙীন শাড়ি, কাঁচের চুড়ি, ঝুটো গয়না উপহার, কখনো কোন উপহার ছাড়াই শাক সবজী ঝুড়ি উজাড় করা। পূজার সময় শহরের বইনারী দিতেন একটা নূতন শাড়ি। কোন কোন চালাক গৃহিনী সারা বছর উপহার নিয়েও পুজোর সময় অভাবের জন্যই হোক বা স্বভাবের জন্যই হোক শাড়িটা দিতে পারতেন না। তাতেও কিছু দুঃখ হতো না বইনারীদের। হলেও কিছু বলতে বাঁধতো। কিছু শাক সব্জীই তো, হোক না কষ্টে জোগাড় করা। পুরুষেরা জুমের সুগন্ধী খাসার চাল বা বীরন চাল হাটে নিয়ে গিয়ে সামান্য দামে বিক্রী করে হাসিমুখে পাহাড়ি গ্রামে ফিরে আসতো। সন্ধ্যায় লাঙ্গী পান করে বাঁশি বাজিয়ে গান করতো। জুমে মাচান বেঁধে সারা রাত বুনো শুয়োরের উপদ্রব থেকে ফসল বাঁচাতো। ঝগড়া বিবাদ হতো, মীমাংসাও হয়ে যেতো চটপট। সবুজ পাহাড়, ঝর্না, ছোট নদী, টংঘরে গ্রাম আর ধাপে ধাপে জুম ক্ষেত – সুখ সোয়াস্তি আর শান্তির জীবন।
এক জুনের দুপুরে একটি ছেলে টাক্কাল দিয়ে বাজারে বসে আনারস কেটে খাচ্ছিল। বোকা আর ফাজিল অল্পশিক্ষিত সদ্যোযুবক, কি খেয়ালে হঠাৎ চেঁচিয়ে বললো – কাইট্টা লামু। কেন কে জানে তার বন্ধুও চ্যাঁচালো – কাইট্টা লাইল। ঠাট্টা না ষড়যন্ত্র কে জানে, শোরগোল উঠে গেল দাঙ্গা শুরু হয়েছে। পরিনতিতে মান্দাইতে মরে গেল অনেকগুলো লোক। বাঙালীরা ভয় পেলো, আদিবাসীরা আরো বেশী। সবাই সবাইকে ভয় করে। পাহাড়ী বইনারীরা শহরে যাওয়া ছাড়লো। বাঙালী ফেরিওলা আর পাহাড়ি গ্রামে আসে না। হোস্টেল ছাড়িয়ে বাবা সুচিত্রাকে নিয়ে এল গ্রামে, ভরসা হলো না মেয়েকে বাঙালী প্রধান শহরে রাখতে। সুচিত্রা কেঁদেছিল খুব। কাকলী, রোয়ালী ওরা তো পড়লো, স্কুলে কলেজে, হোস্টেলেই থাকলো। ওরা এখন অফিসে ইস্কুলে চাকরী করে কতো ভালো আছে। তা সুচিত্রা আর খারাপ কি আছে। মহাত্মাগান্ধী জমাতিয়া লোক ভালো। সরল সবল কর্মঠ। ছেলেটা বড়। পড়াতে মন নেই। এখন বাঁশী বাজায় পাবলিসিটির ফাংশনে। তা বাজাক। ওর খুশীতে সুচিত্রা বাধা দেয় না। বন্দনাকে পড়ায় সুচিত্রা। ঐ তেলিয়ামুড়া স্কুলের হোস্টেলেই রাখবে। এখনো সুচিত্রার কয়েকজন পুরনো দিদিমনি, মাস্টারমশাই ঐ স্কুলে আছেন। সুচিত্রার মেয়েকে ওরা যত্ন করেই দেখাশোনা করবে। দু’চারজন আদিবাসী টীচারও এখন ঐ স্কুলে আছেন। সুচিত্রা বন্দনাকে শেখায় – এসেছে শরৎ হিমের পরশ লেগেছে – বলতে গিয়ে থমকে যায় তার জিভ – শরৎকে বলে শরট, পরশকে বলে পরছ। মেয়েরা ওকে নিয়ে হাসতো। শহরে মেয়েদের জিভ আরো পরিষ্কার। সুচিত্রা ক্লাসে পড়া বলতো না। লজ্জায় চুপ করে থাকতো। ভিতরে ফুঁসতো। বন্দনা সরু গলায় বলে – এথেতে থরৎ। সুচিত্রা একটা ছোট থাপ্পড় মারে – বল শরট। বলে নিজেই থমকে যায় – ওর জিভেও তো শরৎ আসছে না। কি শেখাবে সে মেয়েকে? বন্দনাকেও কি খ্যাপাবে সবাই? জিভে না এলে কলমেও আসে না। আদিবাসী ছেলেমেয়েদের খাতা দিদিমনি স্যাররা ক্লাসে পড়ে শোনান আর হাসেন। রাম রাজা ডশরথের আদেছে বনে গমন করিয়াসিলেন বা পৃথিবী সূর্যের সারিদিকে ঘুরে। কত কিছু নিয়েই সমস্যা। সংস্কৃতের পন্ডিতমশাই রম্ভা শব্দের অর্থ বলেন কলা। ছোট্ট সুচিত্রা বুঝতে পারেনি কলা কোন ফল। ওরা থাইলিক খায়, তাকে যে পন্ডিতমশাই কলা বলেন তা কি করে জানবে। এসব মুশকিলে কত আদিবাসী ছেলেমেয়ে পড়া ছেড়ে দেয়। অনেকে চালিয়েও যায়; সুচিত্রাও চালিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু জুনের দাঙ্গা সব অন্যরকম করে দিল। কিন্তু এখন অনেক দিদিমনি মাস্টারমশাইও ত্রিপুরী, মিজো, ডারলং লুসাই। তাঁরা নিশ্চয় বন্দনার উচ্চারন নিয়ে হাসবেন না। দাঙ্গাও কবে থেমে গেছে। বন্দনা পড়াশোনা করবে, বড় হবে। সুচিত্রাসেন জমাতিয়া আগামীকালের গৃহস্থালীর আয়োজনে মন দেয়। রাতের খাবার বাড়ে স্টিলের থালায়। কাঠের বাসনগুলি তুলে রেখেছে। মাহাত্মাগান্ধী চারটি স্টিলের থালা কিনে এনেছে। ঝকঝকে কি সুন্দর। শহরের দোকান থেকে কিনে আনা। শহর ঢুকছে গ্রামে। কত কিছুর মধ্যে দিয়ে শহর ঢুকছে গ্রামে।
***
বন্দনার রেজাল্ট নিয়ে মুকতাছবি গ্রাম খুশি। মাধ্যমিকে ফার্স্ট ডিভিশন, পুরো মহকুমায় একটি মাত্র ট্রাইবেল মেয়ে। সুচিত্রার দু’একটি পাকাচুল দেখা দিয়েছে কিন্তু তৃপ্তির আলোতে মুখখানি অনেক ঝলমলে হয়েছে। সুশ্রী সপ্রতিভ মেয়ে তার, আগরতলা গিয়ে তুলসীবতী স্কুলের হোস্টেলে থেকে সায়েন্স নিয়ে পড়বে। তারপর আরো আরো অনেক স্বপ্ন ঝলমল করে মহাত্মাগান্ধী আর সুচিত্রাসেনের মগজের উঠোনে।
শহর ঢুকছে পাহাড়ী গ্রামে। ভালো লাগে। ভয়ও করে। সুচিত্রা, রত্নমালা, কার্তিককন্যারা নিজেদের মধ্য আলোচনা করে। ওদের কৈশোরে শহরের জন্য দুর্মর টান ছিলো। ঝলমলে সিনেমা, রকমারী জিনিসে সাজানো হকার্স কর্ণার। ত্রিপুরেশ্বরী স্টোর্সের কাঁচের চুড়ি ঝুটো গয়না। মায়েদের আমলের টাকার মালা ওদেরও ভালো লাগতো না। চিরকাল গ্রামেই থাকবে ভাবতে চাইতো না। কিন্তু দল বেঁধে যখন রাজপথে হাঁটতো তখনই বুঝতো শহরে ওদের জন্যে কত অসম্মান। টিটকিরী ব্যঙ্গ। আজকাল গ্রামে প্রায়ই স্কুটার মোটরসাইকেলে শহরের ছেলেরা আসে। মাঝে মাঝে সঙ্গে মেয়েরাও। ওরা জুম ক্ষেতে কাজ করা পাছড়া পরা মেয়েদের কাছে ভুট্টা পোড়া খেতে চায়। কেউ কেউ শহরের স্টেজে নাচের বায়না নিয়ে আসে। সরল পাহাড়ী মা বাবারা আপত্তি করে না। কিন্তু মাঝে মাঝে তাল কেটে যায়। ছেলেদের সঙ্গে ছেলেদের বচসা হয়। কখনো কখনো মেয়েরা এমন সব উপহার ঘরে নিয়ে আসে, পাহাড়ী মায়েরা মেনে নিতে পারে না। মায়ে ঝিয়ে ঝগড়া হয়। তা কি আর করা, এরকম তো হয়েই থাকে। শহর এখন ঢুকে যাচ্ছে গ্রামে।
জীবন নিজের নিয়মে চলতে থাকে, বৈশাখে যদি গড়িয়াদেবতার সোনার মূর্তি বাঁশের দোলায় চড়ে গ্রাম ভ্রমণ করেন তো আশ্বিনে দু’চারটি গ্রাম মিলে শালতলী হাটে দুর্গাপুজার আয়োজন চলে। বদরুদ্দিন কামলা কাঠ বাঁশ দিয়ে সুন্দর মণ্ডপ গড়ে দেয় কম মজুরীতে। সীতানাথ পাল বউ ছেলে নিয়ে রামহরি মোড়লের বাড়িতে বাস করে দু’মাসে সুন্দর দুর্গা মা তৈরী করে দেয়, ছেলে মেয়ে এমনকি চালার ওপর শিবঠাকুরটি ঢুলুঢুলু চোখে। মাটির গয়না পাটের চুল; ঢাকীও এল বাঙালী গ্রাম থেকে। ছেলেরা দিব্যি জিনস পরে ধুনুচী নাচলো। মেয়েরা স্নান করে নগেন ভটচাযের আদেশ মেনে মেনে পুজোর কাজ করলো। এলাকার প্রথম দুর্গাপুজার আয়োজনে পাহাড় আর সমতল এক হতে চাইলো। বাঙালী গ্রামের মেয়ে বৌরা সিঁদুর খেললো পাহাড়ী মেয়েদের সঙ্গে। মরিয়ম সুজান ভুলে গেল মিশনে পড়তে গিয়ে ওরা সদাপ্রভুর শরণ নিয়েছে। টিলা বনভূমি ঝর্নার সরল ছন্দের দেশে কোন বেতাল দেখা গেল না
কিন্তু আজকাল দু’চারজন রাম সিং অর্জুন সর্দারও গ্রামে আসে। সীমান্তে ওদের ব্যাবসা, কি ব্যাবসা কে খবরনেবে। এদের হাবভাব চালচলন বরক হালাং মিজো কুকী বা এখানকার বাঙালীদের মত নয়। দেখতে ওরাঅনেক সুন্দর। লম্বা, সুঠাম, হিন্দী সিনেমার ভীড়ের দৃশ্যে ওরা থাকে। ওদের ভাষা দুর্বোধ্য বাংলা। কিন্তু মানুষগুলো মিশুকে। এক বছর আগে গ্রামের মেয়ে ফুলকুমারীকে নিয়ে গেল দিল্লী না কই এক আধবুড়ো লোক তার ছেলের বৌ করবে বলে। মোড়লের আপত্তি ছিল। কিন্তু মা নেই, বাবাও দাঙ্গার সময় মিথ্যে মামলায় ফেঁসে গিয়ে ঘরছাড়া। ভাইবৌকে ফাঁকি দিয়ে চলে গেল বুড়োর সঙ্গে, তার খবর আর পাওয়া যায়নি। ভাইবৌ খোঁজ করে না কিন্তু গ্রামের মানুষ বলাবলি করে – কি হলো কে জানে। এখন গ্রামে একটি দুটি টিভি আছে, কত কি দেখায়। পাহাড়ী গ্রামে দুঃস্বপ্ন এসে গেছে। ছেলেমেয়ে নিয়ে শান্তি নেই কারো মনে। আগে শহর ছিল আলো আর দোকানে সাজানো স্বর্গ। এখন এমন কিছু দেখায়, ভয়ে বুক ধড়্ফড় করে সরল মানুষগুলোর। বুনো শুয়োর জংলি হাতি সাপ শেয়াল নিয়ে যে ভয় এ ভয় তার চেয়ে আলাদা। তা ভরসাএকটাই, এ রাজ্যের শহর গুলো তো আর টিভির শহরগুলোর মত নয়। ছেলেগুলোর সঙ্গে মেয়েগুলোও তাই একটু একটু স্বাধীনতা পায়। শহরে পড়ে, সিনেমা দেখে, স্বপ্নও দেখে। বন্দনা মায়ের স্বপ্নে দেখা দিদিমনি হতেচায় না। ও হবে এয়ার হস্টেস। সিঙ্গারবিল বিমানবন্দর ওর বেড়ানোর প্রিয় জায়গা। লাউঞ্জ টিকিট কেটে ঢুকে যায়, পরীর মত মেয়েদের দেখে। রাতে পরীক্ষার পড়া পড়তে বসে আনমনে ভাবে উড়ে যাচ্ছে নীল আকাশে। পরনে সিল্ক শাড়ি, উঁচু খোঁপা, লিপস্টিক। মাকে মাঝেমাঝে বলেও স্বপ্নের কথা, মা আমল দেয় না। রেগেও যায় কখনো। তাতে কি, বন্দনা আকাশে উড়ছে। বিদেশের মাটিতে নামছে, হাতে সাজের বাক্স, ঠোঁট টুকটুকে লাল। মাঝেমাঝে মুখ ভার, পার্লারের টাকা বাবা দিতে চায় না। ওর তো নিজেকে তৈরী করতে হবে উড়ানের জন্যে। ও কি টাকার মালা গলায় পরে শাখানটাঙে হজাগিরি নাচবে?
ক্যাপিটাল কম্প্লেক্সে ফ্ল্যাট নিয়ে ফেয়ারীজ হেভেন বিউটি পার্লার চালান মিসেস শর্মা। কি চৌকস বাপরে বাপ। সুন্দরী পাহাড়ি মেয়েদের ট্রেনিংও দেন। তারা চুল কাটে, ফেসিয়াল পেডিকিওর করে। কেউ কেউ হস্টেল থেকে বেরোয় টিউশন যাবার নাম করে। বাড়তি রোজগার – মিসেস শর্মা যা দেন ওদের কাছে কম কি? সিনেমা দেখে, বটতলা থেকে বিদেশী প্রসাধন কেনে, ডেড সাহেবের বাজার থেকে জিন্স। রিয়া পাছড়া আর ভালো লাগে না। গ্রামের ছেলেদের বাঁশি ভালোলাগে না। জার্মান দেববর্মা শারুক্খান কলই ছুটির দিনে দেখা করতে এলে গল্প জমেনা। একদিন এদের সঙ্গে ঝর্নার জলে পাহাড়ের ঢালে কত না দুরন্তপনা করেছে। এখন এড়িয়ে চলে। দু’দিন পরে আকাশে উড়বে, ফিটফাট পাইলট, ধোপদুরস্ত যাত্রী, বন্দনা ট্রলি ঠেলে ঠেলে কফি চা কেক তুলে দেবে হাতে। বন্দনা স্বপ্ন দেখে। সুচিত্রা স্বপ্ন দেখে – বন্দনা দিদিমনির মত তার মেয়ে বন্দনা ক্লাসে পড়াচ্ছে – সামনে সুশৃঙ্খল ছাত্রীরা। আরো দেখে পাশের তৈদুগ্রামের রাজেশ জমাতিয়ার সঙ্গে বন্দনার বিয়ে। সাততলা কাপড়ের মন্ডপ হচ্ছে – সম্পন্ন জমাতিয়া বিয়েতে যেমন হয়। যুধিষ্ঠির সর্দারে ছেলে রাজেশ জয়েন্ট পেয়ে আগরতলা মেডিকেল কলেজে পড়ে। ওর মা সুচিত্রার সই। মেয়ে সুখী হবে, মা বাপ সুখী হবে, চৌদ্দ দেব্তা আশীর্বাদ করবেন। একটাই ভয় ছেলেটা না খৃষ্টান হয়ে যায়, সেন্ট পল’স এ পড়তো তো, মাতাইকতর রুষ্ট হবেন, এখন তো পাহাড়ে যীশুবাবা এসে গেছেন।
মিসেস শর্মার সঙ্গে কথা হয়ে গেছে, শর্মাজী তিনমাস পরে দিল্লী যাবেন, সঙ্গে যাবেন তার বৌদি।দিল্লীতে থাকা খাওয়ার চিন্তা? ওদের বিরাট বাড়ি। আরো দুটি মেয়ে যাবে, গরীব বাঙালী। আয়ার কাজ খুঁজবে। এখন মাকে বলবে না। প্লেনে করে চলে যাবে, গিয়েই মাকে ফোন করবে। গ্রামে আজকাল অনেকেরই মোবাইলফোন। মা বাবা অবাক হবে, রাগ করবে, কিন্তু বন্দনা যখন এয়ারহোস্টেস হবে, ওরা তো খুশী হবেই। সতেরো বছরের আদিবাসী কিশোরী নিজের মত প্রস্তুতি নেয়। ততদিনে এইচেস পরীক্ষা হয়ে যাবে, পাহাড় এবার দেশের রাজধানীতে পা ফেলবেই।
মা বাবা ভাই কারোরই পছন্দ হয় না মেয়ের হাবভাব। আনমনা, একটু অহঙ্কারী, বেপরোয়া জেদী। কিন্তু শহর থেকে পড়াশোনা বন্ধ করিয়ে নিয়ে আসতেও মন চায় না। বন্দনা বড় হবে, বন্দনা দিদিমনি হবে। সুচিত্রা ভাবে আর ধানের চারা বোনে জুমের ঢালে। ক’মাস পর সুগন্ধী জুমের খাসার চাল নিয়ে মহাত্মাগান্ধী শহরে যাবে, ভালো দামে বিক্রী হবে। কেনা হবে ভেতরে তামার পুঁতি দেওয়া সোনার মটরমালা হার। মেয়ের বিয়ে দিতেহবে। এখন আর বাঁশের কানের দুল টাকার মালা দিয়ে মেয়ের বিয়ে দেয় না কেউ। দুরকমের গোদক হবে, শুয়োরের মাংস, আইসক্রীম। বাঁশের চোঙের দই বাদ, পাহাড় এখন জঙ্গল নয়, শহর ঢুকেছে পাহাড়ে।
বটতলার বাজার, সীমান্ত দিয়ে বিদেশী পণ্য পৌঁছয়। চোরাই পণ্য, দামে শস্তা, দেখতে শৌখিন। মেয়ে নাকি আজকাল নার্সারীর বাচ্চাদের এবিসিডি শিখিয়ে টাকা পায়। সেই টাকায় কেনা ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। কাল পরীক্ষা। পরীক্ষা শেষে বাড়ি ফিরবে। এই ক’দিন হোস্টেলে থাকবে। চৌদ্দ দেবতার উদ্দেশ্য কপালে হাত ঠেকিয়ে বেরুলো। মা বাবার সঙ্গেই, একা নয়।
আজ বাইশ তারিখ। আজ বন্দনা ফিরে আসবে। দুটি বীরন চালের ভাত রাঁধে মা। বাবা ধরে আনে ক’টি পুঁটিমাছ। তেল দিয়ে ভেজে রাখো – গিন্নীকে বলেন মহাত্মাগান্ধী। শহরে থেকে মেয়ের রুচি পাল্টেছে। ওদেরগ্রামে আগে তেল খাওয়ার চল ছিল না। নানা ভেষজ লতাপাতায় ওদের রান্না। বিশেষ ধরনের কলাগাছ পোড়ানো ছাইয়ের ব্যবহার হতো ঝোলে। তাই বোধয় মাখনের মত ত্বক, সিল্কের মত চুল, সহজ সুন্দরী মেয়েরা। তবে বাঁশের চোঙে পাতা মোষের দুধের দই এখনো ভালোবাসে বন্দনা। সব জোগাড় হয়। মামাবাড়ি থেকে এসেছে পাকা চীনার। লেখাপড়া শিখছে ভাগ্নী, ওবাড়িও খুশি।
মেয়ে তো আসেনা। রেডিওতে স্থানীয় সংবাদ, ককবরক খবর শেষ। চিন্তা বাড়ে। আজ আসবে না তবে?
সিনেমা দেখে কাল আসবে? না কাল সকালে বিশংছড়া থেকে বাস ধরে যেতে হবে আগরতলা। নিয়ে আসবে বন্দনাকে। এত স্বাধীনতা দেওয়া যাবে না। মাছভাজাগুলি তুলে রাখে সুচিত্রা। গান্ধী পায়চারী করে ভুট্টাক্ষেতের পাশে।
না। মেয়ে হস্টেলে ফেরেনি। টেস্টের ফল বেরোনোর পর ওরা আর নিয়মমাফিক হস্টেলের বাসিন্দা নয়। পরীক্ষার কদিন ছাত্রীদের হস্টেলে থাকতে দেওয়া হয় কিন্তু দায়িত্ব হস্টেলের নয়।
***
গৌহাটি ছেড়েছে ট্রেন। তিনটি মেয়ে অঝোরে কেঁদে চলেছে। সঙ্গে দুই মহিলা এক ভদ্রলোক। দৃশ্যত অবাঙালী। ভাঙা বাংলায় কথা বলছে। সাংবাদিক অনির্বান রায় ধর্মনগর থেকে দলটিকে খেয়ালে রেখেছিল।ওরা আগরতলা থেকে ট্রেন ধরেনি, ধর্মনগরে বাসে এসে ট্রেন ধরেছে। মেয়েরা তখন থেকে একটু ত্রস্ত ছিল।এখন পুরো ভেঙে পড়েছে। অনির্বান কামরা থেকে বেরিয়ে দরজার দিকে যায় নেটওয়ার্কের সন্ধানে, বিশংখোলার সোর্স জানিয়েছে গ্রামের একটি উপজাতি মেয়ে মিসিং, এক্সক্লুসিভ হতে পারে, এখনো বাইরে খবর যায়নি। অনির্বান ফোন তোলে- হ্যালো হ্যালো…
জমাতিয়া হুদার মিটিং চলছে। বাঙালী পাড়ায় আত্মরক্ষার অসহায় প্রচেষ্টা। শহর পাহাড়ে ঢুকেছে। পাহাড় আবার শহরে ফাঁদ কেটে ফিরে আসবে তো? জুম ক্ষেতের কিনারে কড়ই গাছের তলায় পানে ভোজনে হজাগিরি নাচে নারী পুরুষের অবাধ উল্লাস ধ্বংস হবে না তো সভ্যতার সংকটে? অরণ্য তার অধিকার রাখতেপারবে তো? সম্মান? অনির্বান চেষ্টা করছে – হ্যালো হ্যালো…
জমাতিয়া হুদার নিজস্ব আইন। সেখানে কর্তাব্যাক্তিরা ভালো লোক। কিন্তু বুধাইকিশোরের মতিগতি একটুকেমন যেন। তার হাতে সোনার আংটি, স্কুটার চড়ে। বিশেষ পার্টির সঙ্গে ওঠাবসা। সে কি চায়? একটা জাতিদাঙ্গা? অপহরণের অভিযোগ? গ্রামের প্রবীণরা চান না। দাঙ্গায় কার লাভ? এখন বুধাই উঠতি নেতা। ওর হাতে ক্ষমতা আছে। ও বক্তৃতা দেয়, ইংরেজী শব্দের তুবড়ী – প্রবীন মোড়লেরা ঘোলা চোখে ঠাহর করা চেষ্টাকরেন দুর্বোধ্য ভবিষ্যৎ।
কুসুমবাহারের নতুন মোবাইল বেজে ওঠে। কি খবর, কি খবর, কি খবর? নূতন যন্ত্রে নূতন খবর। ভালো খবর না খারাপ? কি খবর আসছে পাহাড়ের গ্রামে?
কড়ই গাছের ছায়া কাঁপে আগুনের ধারে, দূরে দেখা যায় শহরে আবছা আলো। ছড়ার জল বয়ে চলে পাহাড় থেকে নেমে, কুলকুল শব্দ ভেসে আসে।

Facebook Comments