গুপ্তযুগের বণিক সংঘ

দেড় হাজার বছর আগেকার কথা । গুজরাটের লাট থেকে একদল রেশম-তন্তুবায় তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছল মধ্য ভারতের দশপুর নামে এক ছোট্ট শহরে।
কেন তাদের আদি বাসস্থান ছেড়ে এতদূর আসতে হল, ইতিহাস থেকে সে কথা জানা যায় না । কিন্তু এখানে এসে তারা তাদের নতুন জীবনে যে অত্যন্ত সম্পদশালী হয়ে ওঠে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই । প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে, এই সম্প্রদায় নিজের খরচায় নির্মাণ করায় এক বিশাল সূর্যমন্দির । ৪৩৭-৮ সালের শীতকালে সম্পন্ন হয় তার প্রতিষ্ঠা অনুষ্ঠান ।
কেটে যায় অনেকগুলো বছর । কোন এক প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ হয় মন্দির । ফের আর্থিক সাহায্য করে রেশম-তন্তুবায় সম্প্রদায় । ৪৭৩-৭৪ সালে শুরু হয় মন্দির সংস্কারের কাজ, রেশম-তন্তুবায় সম্প্রদায় তার ভার দেয় বৎসভট্টি নামক এক সূর্য উপাসককে ।
এই দশপুর আজকের মধ্যপ্রদেশের মান্দাসোরে । এখানেই পাওয়া এক শিলালেখে এইসমস্ত কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন এই বৎসভট্টি ।
হারিয়ে যাওয়া এই কাহিনীটি থেকে গুপ্তযুগের ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ ছবিটি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বোঝাই যায়, এই রেশম-তন্তুবায়দের নিজস্ব সংঘ বা গিল্ড ছিল, এবং নিঃসন্দেহে সেই গিল্ড অত্যন্ত ধনশালী ছিল ।
বাণিজ্য যে গুপ্তযুগে কতটা গুরুত্বপূর্ণ ছিল সেটা খানিকটা গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক ব্যবস্থার দিকে চোখ বোলালেই বুঝতে পারা যায় ।
প্রশাসনের সুবিধের জন্যে গুপ্ত সম্রাটরা তাঁদের রাজত্বকে কয়েকটা বিভাগে ভাগ করেছিলেন । এই বিভাগগুলিকে পূর্বদিকে ‘ভুক্তি’ ও সাম্রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় ‘দেশ’ নামে ডাকা হত । অনেকটা আজকের যুগের রাজ্যের মত। এই ‘দেশ’ বা ‘ভুক্তি’-কে আবার জেলার মত ছোট ছোট ভাগ করা ছিল । এই ছোট বিভাগগুলিকে বলা হত ‘বিষয়’, আর যে প্রশাসক এই বিভাগের দায়িত্বে থাকতেন তাঁর উপাধি ছিল ‘বিষয়পতি’ ।
বিষয়পতির কাজে সাহায্য করার জন্য নানান রাজকর্মচারীর পাশাপাশি একটা উপদেষ্টা পরিষদ বা অ্যাডভাইসরি কমিটি ছিল । এই কমিটির নাম ছিল অধিকরণ বা অধিষ্ঠানাধিকরণ । জেলা বা বিষয়ের গণ্যমান্য ব্যক্তিরা এই কমিটির সদস্য হতেন । তাঁদের বলা হত বিষয়-মহত্তর । কিন্তু এঁরা ছাড়াও কমিটির মুখ্য সদস্যদের মধ্যে থাকতেন নগরশ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, প্রথমকুলিক আর প্রথমকায়স্থ ।
নগরশ্রেষ্ঠী ছিলেন জেলার বা শহরের মুখ্য ব্যবসায়ী । যিনি দুর-দুরান্তে শকটে মালপত্র নিয়ে ব্যবসা করতে যেতেন তিনি সার্থবাহ। জেলার কারিগরদের মধ্যে যিনি প্রধান তিনি প্রথমকুলিক । আর প্রথমকায়স্থ হলেন প্রধান লিপিকার ।
আজকের চোখ দিয়ে দেখলে গুপ্ত সাম্রাজ্যে একজন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট পদমর্যাদার মুখ্য প্রশাসকের অ্যাডভাইসর হিসেবে তিন-চারজন বিজনেস বা ট্রেড রেপ্রেজেন্টেটিভ থাকতেন । এর থেকে বোঝা যায় গুপ্তযুগের সমাজ ও অর্থনীতিতে বণিক ও শিল্পী-কারিগরদের কতটা প্রভাব প্রতিপত্তি ছিল ।
এই সব কারিগর ও বণিকদের নিজস্ব সংগঠন বা গিল্ড ছিল । এইসব গিল্ডকে কখনো ‘নিগম’ , কখনো ‘শ্রেণী’ আবার কখনো ‘সংঘ’ বলা হত । গুপ্তযুগের নানা সীলমোহরে ‘শ্রেষ্ঠী-সার্থবাহ-কুলিক নিগম’, ‘শ্রেষ্ঠী-কুলিক-নিগম’, ‘শ্রেষ্ঠী-নিগম’, ‘কুলিক নিগম’ ইত্যাদি নাম পাওয়া গেছে । এর থেকে মোটামুটি আন্দাজ করা যায় কারিগর, ট্রান্সপোর্টার আর মার্চেন্টদের যেমন আলাদা আলাদা সংগঠন ছিলো, তেমনি আবার সম্মিলিত অ্যাসোশিয়েশনও ছিল । এধরণের প্রতিটি গিল্ডের আলাদা সীলমোহরের ব্যবহারও বেশ তাৎপর্য্যপূর্ণ। এর সঙ্গে অনেকটা আধুনিক কালের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের লোগো ব্যবহারের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। অর্থাৎ এই সংগঠনগুলি সেযুগে সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ ও স্বাধীন ভূমিকা পালন করত ।
গুপ্তযুগের বিভিন্ন ধরণের গিল্ডের কথা নানা গ্রন্থে আর শিলালেখে পাওয়া যায় । শুরুতেই দশপুরের রেশম-বস্ত্রজীবীদের গিল্ডের কথা আগে বলেছি । স্কন্দগুপ্তের একটি তাম্রশাসনে তৈলিক-শ্রেণীর কথা পাওয়া যায় । কালিদাসের রঘুবংশে স্থপতি সংঘের কথা আছে । বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষসে আছে মণিকার সংঘের কথা ।
সংঘের সদস্য হওয়ার কিছু নিয়ম ছিল। প্রথমে যিনি সদস্য হতে চান, তাঁর চরিত্র যাচাই করা হত । তারপর তাঁকে একটি অঙ্গীকার পত্র দাখিল করতে হত। এবং সর্বশেষ, কোন পুরনো সদস্যকে তাঁর হয়ে জামিন থাকতে হত।
আবার যদি আধুনিক যুগের সঙ্গে তুলনা টানি, তাহলে খুব একটা তফাৎ পাবো না । মেম্বার হওয়ার আগে প্রথমে ব্যাকগ্রাউণ্ড চেক, তারপর একটা এগ্রিমেণ্টে সই, আর তার সাথে একজন পুরনো মেম্বারের গ্যারাণ্টার হওয়া ।
প্রতিটি সংঘের নিয়মাবলী ও সদস্যদের কর্তব্য সমন্ধে একটি চুক্তিপত্র, বা আজকের ভাষায় মেমোরাণ্ডাম থাকতো । সব সদস্যকেই এই সমস্ত নিয়ম মেনে চলতে হত । নিয়ম ভাঙলে ক্ষেত্রবিশেষে নির্বাসন ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার মত কড়া শাস্তির ব্যবস্থা ছিল ।
এইসব সংঘের সভাপতিকে বলা হত ‘প্রমুখ’ বা ‘সংঘমুখ্য’ । সংঘমুখ্যকে সাহায্য করার জন্য দুই, তিন বা পাঁচজন সদস্যকে নিয়ে একটি কার্যকরী সমিতি বা এক্সিকিউটিভ কমিটি গঠন করা হত । এই সমিতির সদস্যদের বলা হত ‘কার্য-চিন্তক’ । সংঘমুখ্য এবং কার্য-চিন্তকদের মধ্যে বিরোধের জন্যে কাজ-কারবার আটকে গেলে অনেক সময়ে রাজা সংঘের কাজে হস্তক্ষেপ করতেন ।
সংঘের সদস্যদের সংঘের নিয়ম মেনে কাজ করতে হত । সংঘের বিনা অনুমতিতে কোন কাজ করার ফলে সংঘের সম্পত্তির কোন ক্ষতি হলে, দায়ী ব্যক্তিকে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হত ।
নিয়ম ছিল সংঘের সদস্যরা সবাই সমান পরিমাণ মূলধন বিনিয়োগ করবেন । কিন্তু তা সম্ভব না হলে, অর্থাৎ মূলধনের তারতম্য হলে, লাভের অংশও সমান অনুপাতে ভাগ হত।
ব্যবসা ছাড়াও এইসমস্ত গিল্ড বা সংঘ অনেক সময়ে ব্যাঙ্কের মতন কাজ করত । টাকা বিনিয়োগ করা যেত, আবার এই লাভের অংশ দানধ্যানের কাজেও ব্যয় করা যেত । দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের একটি লেখে পাওয়া যায় ব্রাহ্মণদের প্রতিপালনের জন্যে কোন এক মাতৃদাস পরিচালিত একটি সংঘে বিশ দিনার বিনিয়োগের কথা । সত্র প্রতিপালনের জন্যে দুটি সংঘে দু দিনার এবং তেরো দিনার বিনিয়োগের কথা পাওয়া যায় প্রথম কুমারগুপ্তের সমসাময়িক একটি লেখে । স্কন্দগুপ্তের একটি লেখে পাওয়া যায় দেববিষ্ণু নামে এক ব্রাহ্মণের কথা । তিনি ইন্দ্রপুর বা ইন্দোরের একটি সূর্য মন্দিরে নিত্য প্রদীপ জ্বালানোর জন্যে একটি তৈল সংঘে বিনিয়োগ করেছিলেন ।
ইতিহাসের নির্মম রথচক্রে নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেছে গুপ্ত যুগ, সমাজ তার নাব্যতা হারিয়ে হয়ে পড়েছে আড়ষ্ট, গুপ্ত যুগের এই প্রতিষ্ঠানগুলিও আর তাদের পুরনো গৌরব ফিরে পায়নি । তবু আজও বহু বছর পরেও এদের গঠন ও কার্যপ্রণালীর আধুনিকতা দেখে আশ্চর্য হতে হয় ।
এদের নিয়ে হয়ত আরো পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস লেখা এখনো বাকি আছে ।

shib-horz

গুপ্ত যুগের একমুখ শিবলিঙ্গ (বাম দিকে)
গুপ্ত যুগের বিষ্ণু মূর্তি
ছবি : লেখক

তথ্যঋণ :

১। The Vakata-Gupta Age, R.C.Majumdar, A.S.Altekar

২। A History of Early and Medieval India, Upinder Singh

৩। ভারত ইতিহাসের সন্ধানে (১ম ও ২য় খণ্ড), দিলীপকুমার গঙ্গোপাধ্যায়

 

Facebook Comments