জোড়া অণুগল্প

ঘুম

অফিসঘরের জানালাগুলোয় কালো কাচ টানা। বাইরেটা তাই মেঘলা সারাক্ষণ। চোখের আরাম। যাকে বলে, সুদিং। স্বপ্ন স্বপ্ন।

স্বপ্ন পাচ্ছে এখন বাপির। এই ভর বিকেলে। ভীষণ অপ্রত্যাশিত। যাকে বলে, কি যেন, হ্যাঁ আনলাইকলি। কিন্তু তাও পাচ্ছে।

এসিটা ষোলতে। টেবিলের ওপর পড়ে থাকা মোবাইলটা শীতে কেঁপে উঠছে মাঝেমাঝে। ঈপ্সিত কাঁপনটা তো রাতে আসবে… না? হ্যাঁ… রাতে… মোবাইল জানাবে শীৎকার দিয়ে! তাই এখন ওদিকে মন দেওয়ার দরকার নেই।

কিন্তু অবাধ্য আঙুল। কয়েকটা, যাকে বলে, টাচ। কল লগ। স্বপনদা। লাস্ট কল, ইনকামিং, থ্রি আওয়ারস অ্যাগো!

আঙুলের সবচেয়ে বড় সমস্যা, আঙুল স্বপ্ন দেখে না।

পার্ক থেকে ঘুরে এল বাপি একটু আগেই। ছেলেকে নিয়ে। দুজনেই অবাক। বৌ ছেলে। বাপি কী করবে! ওর আজ স্বপ্ন পাচ্ছে।

কিন্তু পার্কেও পাঁচ বছরের ছেলে আর একটু বেশিক্ষণ থাকার বায়না করায়, ‘দেব না বাঁদর ছেলেকে চার থাবড়া…’!

চার! ঠিক গুণে গুণে! বাস্তব জিনিসটা সকালে ঘুম থেকে উঠেই একটা চোঁয়া ঢেকুরের মতো। এই স্বপ্ন-স্বপ্ন ওয়েদারেও ঘাপলা করে যাচ্ছে।

কালো কাচের বাইরে সন্ধে নেমেছে। জোরালো রাত-আলোগুলো ঘোলা ঘোলা। লোডশেডিং-এ জ্বলা হারিকেনের আলোর মতো। হারিকেন, লোডশেডিং সবই স্বপ্ন। একটা ভাড়া ঘর, দুটো তক্তপোষ, পাশে রান্নাঘরে মা, একটা তক্তপোষে বাপি-বিট্টু-দেবী, বিট্টুর দেবীর পেছনে লাগা, বাপির শাসন, ছোট বোন… লজ্জা করে না…

অফিসঘরের হালকা সবুজ দেওয়ালের গায়ে দুটো ছবি। দেবী আর একটা সাদা ঘোড়া। ওটা বাপি। সবুজ ঘাসের ওপর দিয়ে ছুটছে টগবগিয়ে। সুঠাম পেশি, দুটো ফ্ল্যাট, দুটো গাড়ি, গলায় তিনটে মোটা সোনার চেন, সফল প্রোমোটার, সামনে চার কোটির ড্রিম প্রোজেক্ট, স্বপ্ন….

চার! স্বপ্নিল মুডটাকে খালি ছেতরে দিয়ে চলে যাচ্ছে!

দেবী নেই। মেরে ফেলেছে বরটা। ও কুত্তার বাচ্চাকে ছাড়া যাবে না। স্বপনদা বলেছে ব্যবস্থা করবেই। অনেকদিন ধরেই বলছে…

চোখগুলো পায়চারি করছে। দেওয়াল থেকে টেবিলে। মোবাইল কাঁপছে মাঝেমাঝেই। হোয়াটস্যাপ, ফেসবুক, মেসেজ। পাশে কাচের বাক্সের ভেতর ড্রিম প্রোজেক্ট। ঘোলাটে স্বপ্নালু চোখের সামনে অ্যাপার্টমেন্ট, বাংলোর মিনিয়েচারগুলো বড় হয়। তারপর আধখেঁচড়া হয়ে যায় অশ্লীলভাবে।

–এত টাকা আমি কোদ্দিয়ে পাব স্বপনদা? এত বড় কাজ..
–আরে এরকম একটা প্রোজেক্ট তোকে পাইয়ে দিলাম আর টাকার চিন্তা করছিস? কত কামাবি বল তো?
–কিন্তু প্রথমে এত ইনভেস্টমেন্ট…
–চিন্তা করছিস কেন? এটা তুই ম্যানেজ করে নে… তারপর ফিনান্সার জোগাড়, খদ্দের ধরা… এ সব আমরাই সামলে দেব… আমরা আছি তো নাকি!

নিজের যা পুঁজি ছিল তা তো গেছে, ফ্ল্যাটদুটো, বৌয়ের গয়না সব আটকা পড়েছে অ্যাপার্টমেন্টগুলোর আধখেঁচড়া রাক্ষুসে হাঁয়ের মধ্যে। আপাতত চার কোটি।

নাঃ! স্বপ্নের মধ্যে থাকতে হবে ভালো করে। এরকম টাল খাওয়া চলবে না।

রাত বাড়ছে। বৌ ফোন করবে। বাপি হাতকে ড্রয়ার খুলতে বলল।

ঘুমিয়েই সবচেয়ে ভালো স্বপ্ন দেখা যায়। আর ঘোড়ারা দাঁড়িয়ে ঘুমোয়।

 

ধাঁধা ধাঁধা খেলা

–কে? বিট্টু… ও.. মানে… হ্যাঁ, আয়, আয়…. এমন কাণ্ড করলো তোর দাদাটা!! আরে, আমি তো ছিলাম নাকি? আর ব্যবসাতে তো লাভ লস থাকবেই…. তার জন্য একেবারে ঝুলে পড়তে হবে?….
–ছাড়ো….
–আবার ভোটটাও এইসময়ে পড়ে গেল… তা সে আর কটা দিন… তারপরই… কিছুটা রিকভারিও তো হত…
–আরে, ছাড়ো না…
–হুহ… ঠিক আছে… ছাড়, যখন বলছিস…. তা সবকিছু ঠিকঠাক মিটেছে তো? আজকেই আবার অমুকদা আসলো… শ্মশানেও যেতে পারলাম না…
–হ্যাঁ, হ্যাঁ মিটে গেছে…
–বেশ, বেশ… আচ্ছা, এই তোরা এখন যা, রাত হল… কাল সকালে আবার…. ইসস…. ধুসস… ভাবলেই…
–বাড়ীতে সব কান্নাকাটি চলছে… ভাল্লাগছিল না… তাই একটা পাঁইট নিয়ে চলে আসলাম তোমার কাছে….
–বেশ করেছিস… দাঁড়া… এই… দুটো গ্লাস আর কিছু ভাজাভুজি দিয়ে যাও তো…
…….
–একটা ধাঁধা জিগ্যেস করি বলো তো… সোজা…
–আরে… একপাত্তর পেটে পড়তেই বাচ্চা হয়ে গেলি তো…
–আরে, বলো না…
–আচ্ছা, নে বল…
–একটা জেব্রাকে তিন স্টেপে একটা ফ্রিজে ঢোকাও…
–মানে?? জেব্রা, ফ্রিজ, স্টেপ…??
–ওসব ফ্রিজের সাইজটাইজ তোমাকে ভাবতে হবে না… আর স্টেপ বলতে, বোতল থেকে গ্লাসে মদ ঢাললাম, গ্লাসটা তুললাম, ঢক করে খেয়ে নিলাম… এরকম স্টেপ…
–ধুসস… বোকাবোকা প্রশ্ন…
–পারবে না?
–নাঃ..
–ফ্রিজের দরজা খুললাম, জেব্রা ঢোকালাম, দরজা বন্ধ করে দিলাম… হল?
–যাঃ শালা…
–আচ্ছা, নাও নেক্সট..
–আরও?
–হুঁ, শোনো… আকাশ দিয়ে একটা প্লেন যাচ্ছে, তা পাইলট ফিল করলো, প্লেনটা ওভারলোড হয়ে গেছে। তখন ওই মাঝ আকাশ থেকেই একটা কার্টন নীচে ফেলে দেওয়া হল। প্লেনটা কি হল?
–কি আবার হবে?! একটু হাল্কা হল…
–বাঃ, ভেরি গুড… নেক্সট…
–কী কোশ্চেন এগুলো??
–আচ্ছা, এবার একটা হাতিকে চার স্টেপে একটা ফ্রিজে ঢোকাও…
–আবার???
–পারবে না?
–আবার চার স্টেপ কেন? জেব্রাকে যেমন হয়েছিল, তেমন করেই তো হয়ে যাবে…
–না, হবে না…
–কেন? দরজা খুললাম, হাতি ঢোকালাম, বন্ধ করলাম…
–আর জেব্রাটা বের করবে না?
–যাঃ শালা…
–হুম, এটাও পারলে না… পরেরটা বলো…
–বুঝতেই পারছি না শালা…
–পারবে… নাও নেক্সট… মরুভূমিতে একটা উট যাচ্ছিল, যেতে যেতে হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল, কেন?
–এগুলো কি ঝাঁটের প্রশ্ন??
–উত্তর দাও…
–রোদের তাপে…
–উট মরুভূমির জাহাজ, জানো না? ঠিক করে বলো ওসব তাপটাপ বাদ দিয়ে….
–নাঃ, পারবো না….
–হুঁ, প্লেন থেকে যে কার্টনটা ফেলল, ওটা ওর মাথায় পড়েছিল…
–উরিশ্লা….
–নাও, এবার লাস্ট… বনে সিংহর বিয়ে, ও তো রাজা, সবাইকে নেমন্তন্ন করেছে, সবাই গেছেও, একজন বাদে… কে?
–সিংহ…
–পুরো চড়ে গেছে নাকি তোমার? সিংহের বিয়েতে সিংহই নেই?!
–কি করবো?? তোর যত ঝাঁটের প্রশ্ন! এটা ধাঁধাঁ??
–উত্তরটা কি?
–পারবো না…
–হাতিটা যে ফ্রিজে রয়ে গেল, ও আসবে কি করে?
–আরিঃ…. হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ… ভালো দিয়েছিস তো… কোত্থেকে পেলি এগুলো?
–এগুলো আমাদের স্কুল লাইফের মাল… বুঝলে লজিকটা?
–হ্যাঁ, আগেরগুলো মনে রেখে রেখে বলতে হবে… হে হে… বেশ লাগলো কিন্তু…
–হুঁ, পুরো ব্যাপারটা ইন্টারলিংকড… সবকিছু… সবকিছুই একে অন্যের সঙ্গে জড়িত…
–হ্যাঁ, হ্যাঁ… বুঝে গেছি… নে আরেকটা ধর… এবার সব পারবো…
–পারবে?
–আলবাত পারবো…. তুই ধর তো…
–বেশ, বলো দেখি… তোমায় বলা হল একটা ব্যঞ্জনবর্ণ বাদ দিয়ে বাকিগুলো তুলে নিতে… তুমি কোনটা বাদ দেবে?
–একটা বাদ? চন্দ্রবিন্দু…
–বাঃ… আচ্ছা নেক্সট… আমার কাছে যে ছোরাটা থাকতো, সেটা নেই… তাহলে আমি কি হলাম?
–সেই নেপালি খুকরিটা? হারিয়ে ফেলেছিস??
–আরে, এগুলো সত্যি নাকি? উত্তরটা দাও…
–ওঃ… তাই বল… কিন্তু তুই কি হলি? মানে..? ছোরাটা হারালি…
–পারলে না। নিরস্ত্র হলাম… ঠিক করে বলো…
–ওই হল… অত ভারী ভাষা ওসব তোরা জানিস…. খ্যাঁক খ্যাঁক… নে, পরেরটা বল….
–তোমার নাম কি?
–মানে??
–প্রশ্ন.. পরেরটা…
–ও, এটা প্রশ্ন…? আচ্ছা নে, স্বপন হালদার… এটা পারলাম তো? হা হা….
–নাঃ, পারলে না… চন্দ্রবিন্দুটা যে ছেড়ে দিয়েছিলে সেটা দেবে না?
–ওঃ হো… সেই ফেঁসে গেলাম… চন্দ্রবিন্দু..! কিন্তু… ওই শালা বিট্টু, চন্দ্রবিন্দু তো লোক টেঁসে যাওয়ার পর দেয় রে… ওটা তো তোর দাদার নামে যাবে…. খ্যাঁক খ্যাঁক খ্যাঁক খ্যাঁক…
–হুম… ঠিক… পরেরটা করি…
–হ্যাঁ, হ্যাঁ কর… এবার শালা পারবোই… তোর ট্রিক বুঝে গেছি… কর কর…
–তুমি যখন সন্ধেবেলা এই অফিসে এসে বসেছ, জন্মদিনের পোশাকের ওপর ছিল গেঞ্জি, জাঙ্গিয়া, ফতুয়া, পায়জামা, চপ্পল আর দুটো মোবাইল, পেন, চশমা, মানিব্যাগ, ফতুয়ার বুকপকেটে কয়েকটা খুচরো… এই। কিছুক্ষণ পর এগুলোর সাথে তোমার শরীরে আরও একটা জিনিস দেখা গেল… কি?
–আর কি থাকবে? বেরিয়েছি নাকি কোথাও?? এগুলোই…
–পারলে না… আমার যে ছোরাটা হারালো?
–তোর ছোরা আমি নিয়েছি??
–প্রশ্নগুলো খেয়াল করো… কি বলেছিলাম? সব ইন্টারলিংকড… এটা খেলা স্বপনদা… ধাঁধা ধাঁধা খেলা….
–দূর দূর… ওটাই মনে থাকছে না বা… নে, আরেকটা কর দেখি…
–হুঁ… লাস্ট কোশ্চেন…
–হ্যাঁ, বল বল… এটা পারবোই…
–তুমি সাদা ফতুয়া পড়েছ.. একটু পর দেখা গেল তার বুকের কাছে অনেকটা লাল… কি করে?
–মানে??… আঁক….
–এটাও পারলো না শালা…. থুঃ…

Facebook Comments