ব্যোম

image1

বুড়িটা হাঁটছিল টুক টুক করে | খিদে নেই তার | সকালে সেই একসানকি পান্তা খেয়ে বেরিয়েছে , ছোটছেলের বউ আজ তাতে ভালোবেসে আবার একটা কন্দ আলু ও দিয়েছিল | ভারী সোয়াদ তার | আর ঘন্টা দুএক হাঁটতে পারলেই হলো | তারপরে আর এসব নিয়ে ভাবনা চিন্তার দরকার হবে না | আজ কে রোদ ও নেই তেমন, তারপর এ হলো গে তোমার যাকে বলে জঙ্গুলে রাস্তা ….সে যতই বুড়ীর চুলের মত ক্রমশ পাতলা হয়ে আসুক না কেন , এখনো ছায়া দিতে পারে হা ক্লান্ত কে | একা যেতে গিয়ে বুড়ী যদি পথ ভুল করে, তাই ছেলেও রয়েছে সাথে| হাত ধরে ধরে মাকে নিয়ে চলেছে| কিছুটা পরেই চড়াই, মায়ের কষ্ট হতে পারে ভেবে সাথে দড়ির জালি টাও নিয়ে এসেছে | এটাতে বসিয়ে পিঠে করে তুলতে পারবে দরকার হলে| মায়ের ওজন খুব বেশি হলে কেজি পয়তাল্লিশ খানেক হবে, কিন্তু ছেলেই বা কি এমন ভীম ভবানী| ওই তো হাড় জিরজিরে চেহারা, দেহ সৌষ্ঠব বলতে একটা ফুলে ওঠা পেট| এই ছেলেই যখন জন্মেছিল ভুগিয়েছিল অনেক, শেষে চেরা বাখারী দিয়ে নাড়ী কেটে যখন বুড়ী রামি দাই নোংরা মাখা মাংস পিন্ড টাকে তুলে ধরেছিল ,তার রূপ দেখে শুধু তার নয় সারা শ্বশুর বাড়ীর গর্ব আর ধরে না| কিন্তু তারপর সে কি রোগ ব্যাধির দাপাদাপি রে বাবা এটুকু শরীর জুড়ে ….এই যায় কি সেই যায়| সে সব অবশ্য প্রায় প্রায় দু কুড়ি বছর আগে| বারবার ভগমান কে পেন্নাম করে বুড়ি| ছেলেটা বেঁচে গেছে শুধু নয়, আজ সে দুই ছেলে এক মেয়ের বাপ ও বটে| আরো তিন ছেলে, দুই মেয়ে বুড়ির| এক ছেলে শহরে গিয়ে আর ফেরেনি, কেউ জানে না কোথায় গেছে | মেয়েদের বিয়ে হয়ে গেছে কবে ,বড় মেয়ে মারাও গেছে| মুখ ও মনে পড়েনা সবসময় | বুড়ো টাও ও গেছে দু বছর আগে বন্যার জলে ভেসে আসা সাপের কামড়ে| এই টিলাটার ওপরেই ও আর মরদ একদিন উঠে এসেছিল মহুয়া তুলতে না? ওই তো সেই বড় গাছটা, যার পিছনে তারা দুজনে… | ধ্যাত নিজেই লজ্জা পায় বুড়ি | আরেকটু পাশ দিয়ে ঘন্টা তিনেক গেলেই তার বাপের বাড়ীর মোড় টা? ঠিক ঠাহর হয় না বুড়ীর | সই দের সাথে সেই সব জঙ্গুলে নদী ময় হুটোপুটির দিন কাটানো সময় গুলো মাকড়সার জালের মত মগজে ছড়িয়ে পরে| তার মা ডাকছে , বিটিয়া জলদি আয় , রোটি ঠান্ড পড় যায়গা রে! সেসব কদ্দিন আগের কথা? বুড়ীর স্থান কাল পাত্র গন্ড গোল হয়ে যায় এত ভাবতে গিয়ে| ছোট মাথায় এত কিছু রাখতে পারেনা সে| চটকা ভেঙ্গে শরীর একটু অস্থির লাগে , ডাক দেয় ও বেটা একটু পানি পিলা রে|

রাজপাল বুড়ির দিকে তাকায়, মায়ের চামড়া গুলো কেমন ঝুলে পড়েছে| আগে রাশভারী বাপের হাত থেকে বাঁচতে অনেকবার মায়ের আঁচলে মুখ লুকিয়েছে সে| একটা অদ্ভূত মিষ্টি গন্ধ বেরোত মায়ের গা দিয়ে, এখন কিরম একটা বোটকা লাগে| চোখের কোনে পিচুটি ঝুলছে| বলি রেখার ভিড় মুখ জুড়ে| কষ্ট হয় তার মায়ের জন্য| পাশে একটা ঝোরা বয়ে যাচ্ছে, একটা পাতার দোনা বানায়| তাতে জল ভরে মাকে দেয়| নিজের মুখে চোখে জলের ঝাপটা দেয়| তারপর একটু আড়াল করে একটা চুটা ধরায়| আর একটু গেলেই চড়াই শুরু হবে| ফিরতেও হবে তার পর আবার , অবশ্য ফিরতে সময় কম লাগবে| শুধুই নামা তো তখন |

২)

পাহাড়ের পাকদন্ডী শুরু হয়ে গেছে বেশ কিছুক্ষণ| মা কে পিঠে বেঁধে নিয়েছে ছেলে, ধীরে ধীরে উঠছে| বুড়ি মাঝেই মাঝেই এদিক ওদিক প্রশ্ন করে যাচ্ছে, যেমন চাষের জমি টা এবার ছাড়ানো যাবে কি না , নাতনীর বিয়েতে একটা মটোর বাইক কেনা যাবে কিনা, বউ এর জ্বর ছাড়ছে না কেন ডাক্তার কে একবার দেখানো উচিত, কোথায় কি কি কাগজ রেখে গেছে ওদের বাবা, কোনো কোন জায়গায় কিছু সঞ্চয়ী টাকা এখনো ছড়িয়ে, এমনকি দাদার পরিবার! এসব নিয়ে হাজার কথা | টুক টাক উত্তর ও দিচ্ছিল সে হাঁপাতে হাঁপাতে, এত টা রাস্তা| বুড়িও বুঝতে পারছে, ছেলের বুকে হাপর চলছে ধপ ধপ| কি ভাবে আর পিঠে চড়ে থাকে সে, থামতে বলল ছেলেকে| বাকি রাস্তাটা আবার না হয় হাঁটার চেষ্টা করবে| তার পরেই শুনলো মা বলছে, তোর দাদার মাথায় বুদ্ধি শুদ্ধি কম ,শুধু বয়স টাই বেড়েছে ওকে দেখিস কিন্তু বেটা |

দাদার ব্যাপারে প্রশ্ন শুনেই মেজাজ টা খেঁচিয়ে উঠলো রাজপালের | দাদা ..হু…| এতবার বলল একসাথে আসতে, তা তার নাকি রোজ কাটা যাবে| আর টাকা পেলে তো লাফিয়ে লাফিয়ে আসবে| এদিকে এত কষ্ট সব তার| যত সব স্বার্থ পর লোক জনের সাথে থাকা, আবার মায়ের পেটের ভাই | বিরক্তি কাটাতে আরেকটা চুটা ধরায় সে, তেতো স্বাদে উড়িয়ে দিতে চায় সবকিছু| মা এখনও বক বক করেই যাচ্ছে- তাদের বাবার কথা তাদের গাই বলদের কথা, মজে যাওয়া নদী তীর কখনো এসব পেরিয়ে চলে যাচ্ছে তাদের শৈশবে তারপর আবার সটান ফিরে আসছে বর্তমানে| এই মাকে অদ্ভূত লাগে তার| এমন ভাবে কথা বলছে যেন, ছেলের সাথে কুটুম বাড়ী যাচ্ছে ঘুরতে| দু একদিনের জন্য| একবার ও রাগারাগি করছে না,দুঃখ পাচ্ছেনা, চেঁচামিচি করছেনা সাধারণ মানুষের মত| নিজের মাকে কিরম অচেনা লাগে তার, ভয় লাগে| অস্বাভাবিক লাগে তার এইসব আচার আচরণ | মনে হয় , মা কে কত কিছু বলা হয়নি এখনো| কিন্তু, বলতে গেলেই গলার মধ্যে একটা মুঠো যেন পাকিয়ে উঠে তার দম বন্ধ করে দেয়| আর পারছে না সে, ভারী হয়ে আসছে তার পা| ভালো লাগছিল না তার| সামনে কঠিন কাজ এখন! মাকে ঝাঁঝিয়ে উঠে চুপ করতে বলল সে, বলেই নিজের খারাপ লাগলো আরো বেশি| কথা ফুরিয়ে যাবার ভয়েই হয়তো, বুড়ি এবার চুপ করলো | টিলা টা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে এবার| মাকে আবার পিঠে তুলে নিল সে|

অবশেষে বুড়ি নামল ছেলের ঘাড় থেকে, জায়গাটা এখানে বেশ সুন্দর| ওপর থেকে তাদের গ্রামের একটা খোপ খোপ ত্রিমাত্রিক ছবি দেখতে পাওয়া যায়, দুপুর ঢলে পড়ছে আসতে আসতে| কয়েকটা প্রজাপতি উড়ে বেড়াচ্ছে| একটা জাড় জাড় ভাব চারিদিকে| কয়েকটা আস্ত থাকলেও বুড়ি তাই নিজের একটা ছেঁড়া খোঁড়া রাজাই নিয়ে এসেছে সাথে, অভাবের সংসারে এটুকু হিসেব করে চলতে হয়| যা বাঁচাবে তাই বাঁচবে, সাসু মার আপ্ত বাক্য ভোলেনি সে এই বয়সেও| মায়ের জন্য একটা সস্তা প্লাস্টিকের জলের বোতল আলাদা করে নিয়ে এসেছিল বুদ্ধিমান ছেলে, একটা পাথরের পাশে রেখে দেয় সেটা| দুটো মোটা রুটি , একটু আচার আর পেয়াঁজ লঙ্কা ও নিয়ে এসেছে খেয়াল করে | মায়ায় বুড়ির চোখের প্রায় কানা গলি দিয়ে দু ফোঁটা জল বেরিয়ে আসে রাস্তা চিনে চিনে| ছেলে মাকে একটা নমো করে এবার, যাবার সময় হয়েছে| অস্ফুটে বুড়ী প্রার্থনা করে, ছেলে মেয়ে নাতি পুতির জন্য | এসময় টা ভালো না| জঙ্গলে শের ,ভালু , এমনকি বুনো মোষ রা বেরিয়ে আসতে পারে| তাই ছেলেকে তাড়া দেয় ওঠবার জন্য| দূরে একটা বেয়াদপ পাখি মাঝে মাঝেই হঃ হঃ করে ডাকছে| ছেলে মায়ের কাপড় চোপড় ঝেড়ে দেয়, চোর কাঁটা য় ছেয়ে গেছে মায়ের সারা শরীর|

অপসৃয়মান ছেলে র উদ্দ্যেশ্যে এবার ডাক পাড়ে বুড়ি, ঠিক ঠাক খানা খাবি বেটা, রোগা হয়ে যাচ্ছিস কিন্তু খুব| পাখি টা আবার হঃ হঃ করে ওঠে | ছানি পড়া চোখে খুব বেশিদূর দেখা যায় না, ফলত ছেলে খুব দ্রুতই অদৃশ্য হয়ে যায় তার দৃষ্টি সীমা থেকে| এখানে এমনিতে কোনো মানুষ জন আসে না, দু এক ঘর আদিবাসী ছাড়া |তাও সে নমাসে ছমাসে| চাদর টা গায়ে ভাল করে জড়িয়ে নেয় বুড়ী, একটু জল ও খায় বোতল থেকে| এবারে শুধু অপেক্ষা| পাশের জঙ্গল থেকে কিরকম একটা সড় সড় শব্দ ওঠে| একটু বাদেই চরাচর ঘিরে ভয়ানক চাঁদ উঠবে| প্রস্তুত হয় বুড়ি |

৩)

মাকে নামাতে একটু দেরী ই হয়ে গেল তার! যদিও পিঠ আর কাঁধের বোঝা কমেছে বলে এখন একটু হালকা লাগছে কিন্তু ভাবগতিক দেখে মনে হচ্ছে আধাঁর নামবে তাড়াতাড়ি| পা চালাতে হবে | বাড়ীতে সবাই আশা করে বসে রয়েছে| এই দিকে ওঠা বারণ, ফরেস ডিপাটমেন্ট দেখতে পেলেই ফাইন করে, টাকা না থাকলে যা পায় কেড়েকুড়ে নেয়| তার একলা মাথায় চিন্তার ঝড় ওঠে, বিগত কয়েকটা দিন ঘুরপাক খেতে থাকে তাকে ঘিরে, দূরে জঙ্গলে নিভে যাওয়া আগুন থেকে ওঠা ধোঁয়ার মত |

আগে এসব অশান্তি ছিল না, কিন্ত শেষ বছর দশেকে যে কি হলো| আগে ও পাহাড় থেকে মাঝে মাঝে হাতি নেমে আসত ঝাঁপিয়ে পড়ত নতুন খেতের ওপর| তাদের তাড়ানোর জন্য সারা রাত জুড়ে তুমুল ক্যানেস্তারা পেটাত সবাই মিলে,পটকা ফাটাতো| মাঝে মাঝে বুনো শুওর ও নেমে আসত, কিন্তু ওই অবধি| তার পরে শুরু হলো এক নতুন লড়াই |পটকার আওয়াজে হাতি আর ভয় পেলনা| পেট বড় বালাই, গ্রামের লোক বাধ্য হলো তীরে আগুন লাগিয়ে যুদ্ধে নামতে, সাথে আরো অনেক কিছু ।শহরে ইলেকট্রিকের কাজ শেখা শামীম এর সাহায্যে মাঝখানে বিদ্যুতের খুঁটি থেকে তার টেনে বৈদ্যুতিক সীমারেখা বানিয়েও হাতি আটকানোর চেষ্টা করেছিল তারা| কিন্তু, দু একবার তাতে ধাক্কা খেলেও, অচিরেই গোটা কলা গাছ ফেলে বিদ্যুতবাহী তার কেও নির্বিষ করে দিতে শিখে গেল সেয়ানা হাতির দল| সংগ্রাম চলতে থাকলো| এই ধারাবাহিক নিয়মিত লড়াই তে কখনো জিতলো মানুষ, কখনো পশু রা। কিন্তু দু ক্ষেত্রেই যা পড়ে রইলো তা হলো ধর্ষিত ক্ষেত আর তাতে মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা ফসলের শিষ। যে কয়েক ছটাক জমি তে নিজেদের খোরাকির মত ফসল হবে ভেবেছিল, তাও গেল| এতেই শেষ নয়| সাথে শুরু হলো মাংসাশী আক্রমণ, রাতের বেলা গোয়াল ঘর থেকে এমনকি মাঝে মাঝে দিনের বেলাও নিখোঁজ হতে থাকলো গরু বাছুর| তাদের ভুক্তাবশেষ পড়ে থাকতে লাগলো, গ্রামের কাছাকাছি| ওদেরও গেল দুটো গরু, একটা সবে মা হয়েছিল| ফলে বাছুর টাও গেল দু দিনেই| গ্রামের মানুষ ও সেয়ানা হয়েছে ক্রমশ, তারাও সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে আস্তে আস্তে গেরিলা যুদ্ধে অবতীর্ণ হল| চিটেগুড় বাঘের খুব প্রিয়, তাতে কীটনাশক মিশিয়ে তারা ফেলে রাখতে লাগলো বাঘের প্রত্যাশিত আসা যাওয়ার পথে| অচিরেই ফল ফললো| দু দিন বাদেই গ্রামের একটু দূরেই পাওয়া গেল একটা নাবালক বাঘের মৃতদেহ, আর তার এক ঘন্টা বাদে একটা বাঘিনীর, সম্ভবতঃ মা ই হবে| তারপর পরই এলো ফরেস ডিপাটমেন্ট| প্রচুর ধমক ধমক দিয়ে বন্য প্রাণী হত্যা মামলায় জেলে ভরবার হুমকি দিয়ে তাদের জিপ অনেক কালচে ধূসর ধোঁয়া ছেড়ে হারিয়ে গেল দূরে|

খবর পাওয়া গেল হাতি দের যাওয়া আসার রাস্তায় নাকি দেওয়াল তুলেছে সরকার, কোনো উন্নত হাই ওয়ের জন্য| সেখানে নাকি গাড়ি চলবে স্যাঁত স্যাঁত| হাতি চলাচল করে অনেক জায়গা জুড়ে খাবার জন্য, আচমকা মানুষ তার পথ আটকাতে বাধ্য হয়ে বন্য প্রাণ খুঁজে নিতে চেয়েছে নতুন রাস্তা| আর নতুন হাইওয়ের সাথে সাথেই বেড়েছে চোরাই কাঠ পাচার কারীর সংখ্যা| গাছ কাটা পড়ছে ঝপাঝপ, জঙ্গল জ্বালিয়ে দিচ্ছে নির্বিচারে জঙ্গল মাফিয়া রা| আদ্যিকালের বন্দুক নিয়ে সেই সব শক্তিধরদের মহড়া নেবার ক্ষমতা নেই ফরেস ডিপাটমেন্ট এর| ফলে টান পড়েছে পশুদের খাদ্য সম্ভারে তাই তারাও বাধ্য হয়ে নেমে আসছে সমতলে| দশ জনের একটা মাতব্বর দের দল বাধ্য গেছিল ফসলের ক্ষতিপূরণ চাইতে, তাদের খেদিয়ে দেয় ফরেস অফিস থেকে| জঙ্গলে বন্য পশু দের কোনো ক্ষতি করলে সবাইকে জেলে ভরে দেবার উপদেশ ও দিয়ে দেয়, একদম বিনা পয়সায় |

এর পরে সেখানে গেল গ্রামের পঞ্চাশ জন, উপায় না দেখে হাতে লাঠি টাঙ্গি ও রেখেছিল সাথে| ভাগ্যক্রমে সেদিন কোনো এক দপ্তরের মেজ সাহেব ছিলেন| শস্ত্র সমাবেশ দেখে তিনি কিঞ্চিত দ্রব হলেন বটে কিন্তু তাতে যে ক্ষতিপূরণ দেবার কথা হয় , একজনের পরিবারের এক সপ্তাহের খাবার খরচ ও উঠবে না , অথচ বেশীর ভাগ ই সর্বস্বান্ত| পরবর্তী বার গ্রামের সমস্ত লোক নিয়ে এসে আরো দরাদরি করবে কিনা এসব আলোচনা যখন তুঙ্গে, তখন রাজপালেরই চোখে পড়ে একটা ধুলো পড়া পোস্টার, বন্য পশুর আক্রমণে পরিবারের কেউ যদি মারা যায়, পরিবার ক্ষতিপূরণ দাবী করতে পারে ফরেস বাবু দের কাছে| ক্ষতিপূরণের অঙ্কটা চোখ ধাঁধিয়ে দিল তার| ভাগ্যিস বাবা তাকে সাত কেলাস অবধি পড়িয়েছিল| বুদ্ধি টা তখন ই আসে তার মাথায় ….কিন্তু কি করে সেটা ঘটাবে ভাবতে কাল ঘাম ছুটে যায় তার| সেদিন অনেকদিন পর ঠেকে বসে আকন্ঠ দেশী গেলে সে আর দাদা, বলরাজ | দাদার সাথে অনেকক্ষণ আলোচনা করে| দুজনেই দুজন কে সাবধান করে, এনিয়ে এখন আর কিছু না বলতে| কিন্তু, অবশেষে কাউকে তো বলতেই হয়| একটা সিনেমায় দেখেছিল তারা টস করা, সেটা মনে পড়তে দাদা পকেট থেকে একটা পুরনো কয়েন বের করে| রাজপাল ডাকে, ইংলিশে| হেড!

সময় টা খুব ভালো করে মনে আছে তার |সেদিন সকাল হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ| মা খাটিয়ায় বসে বসে দড়ি পাকাচ্ছিল, এখন খুব একটা আর বাইরে কাজ করতে পারেনা| তাকে দেখে বরাবরের মতই ঠিক বুঝতে পারে মা , কিছু হয়েছে নিশ্চয়| তাকায় তার দিকে, জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে বেটা | দূরে বসে একমনে ঠোঁট চাটতে থাকা রোগা কুকুরটা প্রত্যাশা নিয়ে তাকে দেখছিল, বেমক্কা একটা পাথর ছুঁড়ে মারে রাজপাল| ক্যাও ক্যাও করতে সেটা দৌড় দেয় সদরের দিকে| তার পর একমনে খাটিয়ার পায়ার ডিজাইন দেখতে দেখতে উজাড় করে দেয় নিজেকে| তারপর কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ে, সেই পায়া ধরেই| দেখে মা এক দৃষ্টে তাকিয়ে আছে, ছোট ছেলের দিকে| বেশ কিছুক্ষণ দুজনে দুজনকে দেখে, তার চোখ ঝাপসা হয়ে এসেছিল, কিন্তু মা আশ্চর্য্য| আজকের মতই একটুও কাঁদলো না, অভিশাপ দিল না, এমনকি হয়ত অবাক ও হলো না| শুধু জিজ্ঞেস করলো, আজ ই যাই তাহলে | টাকা টার তো খুব ই দরকার বাড়ীতে |

৪)

সামনে খুন খারাপী লালচে চাঁদ উঠেছে একটা, সময়ের আগেই| প্রবল জাড়ে কুঁচকে যাচ্ছে বুড়ীর হার জির জিরে শরীর| এক পাল শিয়াল ডেকে উঠলো কোথাও, গাছে বাঁদর দের দাপাদাপি | সব কিছু তছনছ করে সে আসছে, অবশেষে | মানুষের গায়ের গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে জঙ্গল গভীরে| তাই সাড়া পড়ে গেছে| এবার একটু ভয় লাগে বুড়ীর | বার বার বলে দিয়েছে ছেলেকে , দু দিনের মধ্যে যেন ফেরত আসে | সদগতি না হলে ভূতিয়া জানবর হয়ে ঘুরে বেড়াতে হবে এই বনে বনে | সে পারবে না বুড়ি | মনে মনে কিষণজি কে ডাকে সে ,কপালে হাত ঠেকায়| প্রার্থনা করে ঝট পট সব চুকে যায় যেন | পাগলা কোনো পাখী ডাকছে একটানা, এই নিশুতি রাতের বেলাতেও| বুড়ি চোখ বোঁজে| কুল কুল করে নদী বয়ে যাওয়ার শব্দ ভেসে আসে| ছোটবেলায় দেখা সেই মাঝি টাকে দেখতে পায় আবার গান গাইতে গাইতে তার বাড়ীর সামনে দিয়ে নদী বাইছে| তার মুখটা অবিকল রাজ এর মত| নৌকোর দোলানি লাগে তার| রাত চেপে আসে, আরো কাছাকাছি সজোরে আঁকড়ে ধরে বুড়ী কে |

এতক্ষণে গ্রামের কাঁপা কাঁপা আলো দেখতে পাওয়া যাচ্ছে দূরে, এবার নিশ্চিন্ত| উফ ,যা ভয় ভয় করছিল না তার|  দুদিন পরেই, হিসেব করে রেখেছে সে মায়ের শরীর টা এনে গ্রামের খেতের ধারে ফেলে দেবে| প্রচুর কাঁদবে সে, নিজের পাথর বুকে যে নদী কে চাপা দিয়ে রেখেছে উন্মুক্ত করে দেবে তাকে| তারপর ফরেস অফিসে যাবে সোজা | এবারে দাদা কেও নিয়ে যাবে | টাকাটার সত্যি খুব দরকার তার| দুই পক্ষের হয়েই কঠিন উকিলি লড়াই এ নামে সে, অবশ্যই মনে মনে| দীর্ণ হতে থাকে সে পরস্পর বিরোধী অনুভূতির কাটাকুটি তে| এমন সময় তার খুব কাছেই যেন বেজে উঠলো শেয়ালের পালের ডাক | চারিদিকে তারপর আবার নিস্তব্ধতা , এত ঘন মনে হয় স্পর্শ করা যায় |শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল তার …সারা গা ঘামে সপ সপ করছে | তবে কি!এত কাছে এসে গেছে সে | এরম তো কথা ছিল না! তার দৌড়ে পালানো উচিত নিশ্চয়ই , কিন্তু কোনো অদৃশ্য নোঙ্গর তাকে ধরে রাখে সেখানেই| প্রচন্ড ভয়ে সে একটা বুক ফাটা চিত্কার করে উঠতে চায় ..মা! মা গো ! কিন্তু, যেন তাকে বিদ্রুপ করার জন্যেই তার কাগজের মত শুকনো গলা দিয়ে একটা ফ্যাসফেসে আওয়াজ এর বেশী কিছু বেরিয়ে আসে না | সামনের ঝোপ টা আবার নড়ে ওঠে তারপর|

ছবি: স্নেহাশীষ দত্ত

Facebook Comments


Tags :