অরণ্যে আমার আবাস
এক
প্রাক-অরণ্য বাসের দিনগুলি
চুড়োয় চুড়োয় আটকে থাকা মেঘ আর কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে মাইলের পর মাইল জুড়ে জন্মাবধি দাঁড়িয়ে আছে ঘন জঙ্গলে ঘেরা পৃথিবী বিখ্যাত আকরিক লোহা-পাথরের সারি।

লোহা পাহাড়
এই পাহাড়শ্রেণীর সবচাইতে উঁচু পাহাড়ের নাম লোহাপাহাড়। লোহাপাহাড়ের চুড়োর কাছে ক্যাম্পের নাম লোহাপাহাড় হিল টপ ক্যাম্প আর পাহাড়তলির ক্যাম্প হল লোহাপাহাড় বেস ক্যাম্প। দুই ক্যাম্পের যাতায়াতের জন্য আছে গভীর জঙ্গলের বুক চিরে পাকদণ্ডী কাঁচা রাস্তা ।সদ্য কলেজ থেকে পাস করা আমরা, তাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের আর থাকা খাবার ব্যবস্থাও এই বেস ক্যাম্পে । প্রশিক্ষণের মাঝপথেই, আমাকে বেস ক্যাম্প থেকে বিদায় নিয়ে যেতে হল লোহাপাহাড় হিলটপ ক্যাম্পে। লোহাপাহাড় হিলটপ আসলে এক সুবিশাল চ্যাপ্টা মালভুমি । হিলটপের চুড়ো থেকে একটি ঝরনা বয়ে গেছে ।

লোহাপাহাড় হিল টপ যাবার কাঁচা পাকদণ্ডি রাস্তা
সদ্য কলেজ থেকে পাস করা আমরা, তাদের প্রাথমিক প্রশিক্ষণের আর থাকা খাবার ব্যবস্থাও এই বেস ক্যাম্পে । প্রশিক্ষণের মাঝপথেই, আমাকে বেস ক্যাম্প থেকে বিদায় নিয়ে যেতে হল লোহাপাহাড় হিলটপ ক্যাম্পে।
লোহাপাহাড় হিলটপ আসলে এক সুবিশাল চ্যাপ্টা মালভুমি । হিলটপের চুড়ো থেকে একটি ঝরনা বয়ে গেছে ।
এই ঝরনার অকৃপণ জলধারার কারনেই হয়তো সেখানে গভীর অরন্য আর তাতে বাঘ, হায়না, জংলি শুওর, শঙ্খচূড় আর পাইথনের ছড়াছড়ি । একটু অসাবধান হলেই এই সব হিংস্র প্রাণীর কবলে এসে কিংবা পাহাড়ি নদীর বালিচরে চোরাবালির ফাঁদে পড়ে “চিরতরে নিখোঁজ” তালিকায় নাম ঠাই পেতে পারে।
আমার একটাই সান্ত্বনা। প্রায় সবার কাছেই শুনলাম “কাজ শিখবার সব চাইতে ভালো গুরু হিলটপের ক্যাম্প-ইন-চারজ নায়ার স্যার”।

লোহা পাহাড় হিল টপের ঝর্ণা
দুই
অরণ্যের প্রথম পাঠ
এই ক্যাম্পে নতুন কাজে যোগদানের সময় পাকদণ্ডি রাস্তায় যাবার পথেই বিকেলের শেষবেলাতে দেখা হয়ে গেল বনের মহারাজার। চারদিক খোলা উইলিজ জিপের সামনের সিটে আমি আর স্টিয়ারিং হুইলে নায়ার স্যার, পেছনের সিটে ড্রিলার ম্যথিয়াস আর তার সঙ্গিরা ।
রাস্তা জুড়ে বাঘ শুয়ে আছে দেখে নায়ার স্যার জোরে ব্রেক দিলেও জীপ থামলো কিন্তু সেটা বাঘে-মানুষে মাত্র দশ- বার ফুটের ব্যবধানে। ম্যথিয়াস আমাকে ফিসফিস করে বললে “ভয় পেয়ে চিৎকার করবেন না, সবাই বিপদে পড়বো তা হলে। শুধু খেয়াল রাখবেন নায়ার স্যার কি বলেন” ।
জীপের হেডলাইটের আলো আর ইঞ্জিনের গর্জন ছাড়া আর কিছু শোনা যাচ্ছে না। তবে আমার হৃৎপিণ্ডটা মনে হচ্ছিল এবার লাফিয়ে বেরিয়ে আসবে। কিছুক্ষণ পর আমার হতভম্ব মুখের দিকে চেয়ে নায়ার স্যার ফিসফিসিয়ে বললেন “যে বাঘ দেখা যায়, সে অতটা ভয়ংকর নয়। কিন্তু এখন ইনি রাস্তা খালি করে চলে না যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতেই হবে ।তবে কিছু বেগড়বাই করলে…” ।
উনি আমার হাতে ডিজেলে ভেজানো একটা মশাল আর লাইটার এগিয়ে দিয়ে নিঃস্পৃহ সুরে বলেন “আমি ইশারা করা মাত্র মশাল জ্বালিয়ে জিপ থেকে নেমে পড়ে ম্যাথিয়াসের পেছনে থাকবেন”। সব শুনে আমার পা থেকে মাথা অবধি ঠাণ্ডা হয়ে এই শীতের সন্ধ্যেতেও কপালে থেকে বিন্দু বিন্দু ঘাম গড়িয়ে পড়ল।
ওনার কথা শেষ হয়েছে কি হয় নি কয়েকবার কাশতে কাশতে জিপের ইঞ্জিন চুপ হয়ে গেল আর তার কিছু পরে হেডলাইট হলুদ হয়ে নিবে গেল। চাঁদের হাল্কা আলোতে বোঝা যাচ্ছে যে বাঘ এবার মাঝেমাঝে আধশোয়া হয়ে আমাদের দিকেই ঘাড় ঘুরিয়ে মাঝে মাঝে দেখছে ।
নায়ার বাবু এবার চাপা আওয়াজে সবার উদ্দেশে বললেন “সবাই এবারে সতর্ক থাকো। আমি ইশারা করা মাত্র…” ওনার কথা শেষ হবার আগেই নিচের উপত্যকা থেকে আর একটি বাঘের ডাক কানে এল ।
আমাদের সামনে শুয়ে থাকা বাঘ এবার উঠে দাঁড়িয়ে বোধ হয় একটা জবাবী পিলে চমকানি হাঁক ছাড়ল। বুঝে নিলাম আজ জোড়াবাঘের জলযোগ মন্দ হবে না ।
কিন্তু নায়ার স্যার কি ইসারা করতে ভুলে গেলেন? জীপের পেছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখি ম্যাথিয়াস আর তাঁর সঙ্গিরা বেশ চিন্তামুক্ত হয়ে মালয়ালিতে কি যেন হাসাহাসি করছে। পলকের মধ্যে দেখি ম্যথিয়াস বলে “দেখো সাব ও ভাগা । উধর ভাগা”
বাঘ ততক্ষণে নিচের উপত্যকার পথে। আমি শুধু তার লেজতোলা পেছনের দুটো পা দেখতে পেলাম ।
ওদের কাছে শুনতে পেলাম “বাঘ বাউন্ডুলে হলেও বছরের এই সময়টায় ঘর সংসারি হয়ে যায়। নিচের উপত্যকা থেকে বাঘিনী গৃহিণীর আহ্বান উপেক্ষা করবার বুকের পাটা আছে নাকি?”
মনে হচ্ছে আর একটা বাঁক পেরোলেই লোহাপাহাড় চুড়ো। ড্রিলিং ক্যাম্পটা সেই পাহাড় চুড়োর ঠিক কোলে অনেকটা সমতল জায়গা জুড়ে।
বোধকরি ক্যাম্পে ঢোকবার আগেই আমার জন্যই এখানের আরণ্যক প্রকৃতি একটা হাতেকলমে শেখবার ক্লাসের ব্যবস্থা করেছিলেন।
আমার সাথীরা আমাকে অনেকটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর মত করে দেখিয়ে দিলেন যে অরণ্যে ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা, সুযোগ্য দলনেতা আর মাথা ঠাণ্ডা থাকলে কিভাবে বিপদ থেকে বেরিয়ে আসা যায়। এও বুঝলাম এখন যে এই পুরো ঘটনাটায় এবং সঙ্গিদের সঙ্গগুনে আমার মত ভীরু লোক ও কিন্তু ভয় পেতে ভুলে গেছে ।
আমাদের জীপ বাঁক পেরোতেই চোখে পড়ল এক বিশাল গেট আর চারদিক উঁচু দেওয়ালে ঘেরা হিল টপ ক্যাম্প । দেয়ালের ওপর আরও বেশি সুরক্ষার জন্য মিটার খানেক উঁচু কাঁটাতারের বেড়া ।
ম্যাথিয়াস সেদিকে দেখিয়ে আমাকে বললে “এই দেওয়াল ছাড়াও চারদিকে রয়েছে পাহারাদারেরা । এরা সবসময় কড়া নজর রাখে। নায়ার স্যার পুরো ক্যাম্পটা দুভাগে ভাগ করেছেন পাহাড়ধার আর খাদের ধার, আপনার তাঁবু কোনদিকে খাটাবো? ”
ম্যথিয়াসের পাশে বসা জোসেফ বললে“পাহাড়ধারে একটু গরম বেশি তবে বেশ জমজমাট । আড্ডা ফুর্তি, তাসখেলা এমনি সব নিয়ে অবসর সময় কিভাবে কেটে যায় বোঝা-ই যায় না।”
“আর খাদের ধারে?”
“ ওদিকে থাকতে চাইলে আপনার তাঁবু হবে ওই দিকে সবার শেষে, একটা নতুন সারিতে। এমনিতে খুব সুন্দর জায়গা। সব সময় হাওয়া বইছে আর রোদের তেমন জোর নেই তবে…”
“তবে কি?”
জোসেফ বলে “মাঝ রাত থেকে একটু ঘুমের অসুবিধে হতে পারে। খাদের ধারের জঙ্গল থেকে হায়েনা আর শেয়াল প্রহরে প্রহরে ডেকে যায়। এছাড়া কখনো কখনো বাঘের ডাক ও শোনা যায় । আপনার কোনও কারণে যদি ভয় লাগে তো …। ”
নায়ার স্যার বিরক্ত হলেন বোধকরি ভয়ের কথা শুনেই। ভুরু কুচকে ম্যাথিয়াসকে বললেন “উনি আপাতত গেস্ট হাউসেই থাকুন। দু- এক দিন ওনাকে সময়তো দাও” ।
ভয় যে আমি আর পাই না সে কথাটা মনে হচ্ছে পোড় খাওয়া দলনেতা নায়ার স্যার ধরতে পেরেছেন।
তিন
অরণ্যের অশরীরীরা
গেস্ট হাউসের গেট তো নয় কোনও রাজবাড়ির সিংহদুয়ার যেন। সেটা পার করতেই বিশাল এক দোতলা কাঠের বাড়ি, দুটো তলাতেই প্রশস্ত বারান্দা আর তাতে জায়গায় জায়গায় বেলজিয়ান কাচের দেওয়াল গিরির স্ফটিক থেকে আলো যেন ঠিকরে পড়ছে। কেমন যেন একটা মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক ছাপ পুরো বাড়িটাতে ।
নিচের তলায় প্রধান অফিস আর স্টোর। নায়ার স্যার সেখানে বসেন আর ওপরে দশটি ঘর নিয়ে অতিথি নিবাস। আজ সেখানে আমি ছাড়া আর কোনও অতিথি নেই ।
রাত দশটার পর বনবিভাগের নির্দেশে জেনারেটর, ট্রানজিস্টার রেডিও বা টেপ রেকর্ডার চালানো নিষেধ। খুব প্রয়োজন ছাড়া টর্চ বা কেরোসিন ল্যাম্প জ্বালানোতেও আপত্তি আছে ।
আমার জন্য রাতের খাবার নিয়ে এসেছিল অতিথি নিবাস রক্ষক, অসম রাইফেলসের প্রাক্তন নায়েক সুবেদার মনিরাম সিং। বাংলাটা ঝর ঝর করে বলতে পারে ।তার মুখেই এই সব শুনে ঝটপট খেতে বসে গেলাম।
মনিরাম সিং যাবার সময় দোতলার বারান্দা থেকেই ওর তাঁবু দেখিয়ে দিল। কোনও দরকারে ডাক দিলেই ও দৌড়ে চলে আসবে ।
সারাটা দিন বিরক্তি, ক্লান্তিতে কেটেছে। তার ওপর সন্ধের একটা অংশ তো কেটেছে ভয় আর উত্তেজনার মধ্যে। এসব মিলিয়ে- মিশিয়ে এমন একটা অবস্থায় আছি যে ঘুম আসছে না ।
সামান্য একটু তন্দ্রার মত আসি আসি করছিল কিন্তু মনে হল পাশের ঘরে কি একটা ফিস-ফাস স্বরে কথা চলছে। পাশের ঘরে যেন অনেকেই আছে । আমার ঘরের দেওয়ালের কাছে এসে কান পাতলাম। আর কোনও আওয়াজ নেই ।
বিছানায় আবার ফিরে যাচ্ছি, এই সময় মনে হল আমার ঘরের লাগোয়া ওয়াসরুমে কেউ যেন আছে। প্রথম বার কানে যেতে বিশ্বাস হয় নি। ক্ষণেক পরে আবার শুনি সেই আওয়াজ। এবার আর ভুল হল না। এটা নূপুরের আওয়াজ ।
পাহারাদারদের নজর এড়িয়ে কোনও মহিলা অতিথি নিবাসে ঢুকে গেল আর লুকাল কি না আমারই রুমের ওয়াস-রুমে? ব্যাপারটা আমাকে বদনাম করার জন্য কোনও পাতা ফাঁদ নয়ত?
ব্যাপারটা যাই হোক আমার আর এই রুমের মধ্যে থাকা উচিত নয়। চান-ঘরে কে আছে দেখতে গেলে কোনও ঝামেলাতে জড়িয়ে পড়তে পারি ।
দরজার কাছেই একটা প্রমাণ সাইজের মোটা লাঠি নজরে এল। সেটা হাতে নিয়ে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আমি যে বাইরে বেরিয়ে গেছি সেটা জানান দিতেই দরজাটা বেশ সশব্দে খুলে বাইরে এসে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছি জানান দেবার জন্য ইচ্ছে করে জোরে জোরে পা ফেলে নেমে যাবার শব্দ করলাম। কাঠের সিঁড়িতে একটু জোরে পা ফেললেই বেশ আওয়াজ হয়।
কেউ যদি যে কোনও নিরীহ কারনেই ঢুকে থাকে তাকে যেতে দেবার একটা সুযোগ তো দেওয়া উচিত।
দশটা বেজে গেছে অনেকক্ষণ। জেনেরেটরের আওয়াজ বন্ধ হওয়ায় এখন ঝিঝি পোকার একটানা আওয়াজ আর থেকে থেকে পাহাড়ি নদীর গর্জন শোনা যাচ্ছে ।
আমি পা টিপে টিপে সিঁড়ির দিক থেকে ফিরে আমার রুম পার করে একদম কোনের দিকে মিসকালো অন্ধকারে ঘাপটি মারার মত করে দাঁড়িয়ে রইলাম ।
অনেকক্ষণ পার হয়ে গেছে । আকাশে এখনো সন্ধ্যের দুর্বল একফালি চাঁদের ওপর চলন্ত মেঘ ছোঁ মেরে তার নিস্তেজ আলো কেড়ে নিচ্ছে আবার যাবার সময় দয়া করে ফিরিয়ে দিচ্ছে ।
সে যাই হোক, মেঘের সাথে চাঁদের এই আলো-আঁধারির ছেলেখেলাতে, পুরো বারান্দার ওপর নজরদারি করাটা বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছে ।
তবে কেউ অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে পালিয়ে গেলে ক্ষতি নেই কিন্তু সে আদৌ গেল কি না সেটা জানা আমার জন্য খুব জরুরি ।
এইজন্যই এবার নজর চারদিকে ছড়িয়ে দিতেই হচ্ছে। সেটা করতে গিয়েই একটা গা সিরসির করা রোমহর্ষক দৃশ্য নজরে এল। এটা আজ অবধি সাধারণ জ্ঞান ও বুদ্ধি দিয়ে ব্যাখ্যা করতে বা মেনে নিতে পারিনি ।
চারদিক উঁচু কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা গেস্ট হাউসের সামনের মান্ধাতা আমলের গেট এখন বন্ধ। গেস্ট হাউসের থেকে সামান্য দূরেই তিন মানুষ উঁচু সিংহ- দুয়ার ধাঁচের মেন গেট। নিরাপত্তা কর্মীরা সেই গেট বন্ধ করে এখন গেট থেকে সামান্য দূরেই ওয়াচ টাওয়ার থেকে পুরো ক্যাম্পের ওপর নজর রাখতে ব্যস্ত।
এই ওয়াচ টাওয়ার থেকে চোখ সামান্য সরাতেই নজরে চলে গেল খাদের দিকে। ভাসন্ত মেঘের দল বিদায় নেওয়াতে চাঁদের আলো এখন কিছুটা স্পষ্ট।
জলের প্রবল স্রোত নিয়ে পাহাড়ি নদীর আওয়াজ আসছে। সেই দিক থেকে চোখ সরিয়ে এবার আর এক বার আমার রুমের আর সিঁড়ি রাস্তার দিকে নজর দিতে যাব এমনি সময়েই যা দেখলাম তাতে সব কিছু ভুলে গিয়ে লোহাপাহাড়ের সেই চুড়োর দিকে আর একবার তাকিয়ে দেখতে বাধ্য হলাম।
নদীর পাশের পাহাড় চুড়োতে এখন আলো জ্বলছে বেশ অনেকগুলো। কিছুক্ষণ আগেই চাঁদের ক্ষীণ আলোতে নদীর পাশের পাহাড় চুড়ো দেখেছি। আমি নিশ্চিত যে তখন এই আলোগুলো ছিল না। অন্ধকারে আলো দেখা গেলে তা নজরে আসতে বাধ্য।
পাহাড় চুড়োতে কোনও পুকুর বা জলা জায়গা তো হতেই পারেনা। এই আলোগুলো আলেয়ার আলো বলে উড়িয়ে দেওয়া যায় না ।
জন-মানবহীন এই সব দুর্গম খনিজ আকরিকের চড়াই পাহাড়ে রাখালেরাও পশু চরাতে যায় না। তাহলে এই গভীর রাতে এতো গুলো ছোট ছোট আলো ওখানে কে বা কারা জ্বালিয়েছে?
এক সাথে কেউ এতোগুলো ছোট ছোট উনান ধরায় না। তাহলে কি এগুলো দীপের শিখা? তবে কি ওখানে কোনও তান্ত্রিকের সাধনা শুরু হয়েছে? আমি এই রকম কিছু অনেক আগে পড়েছি তন্ত্রসাধনার কোনও বইতে। সবেমাত্র আমি এই কথা ভাবছি ঠিক সেই সময় যা দেখলাম তাতে গা শিউরে উঠলো।
দীপশিখার সারির ঠিক মাঝখানের দুটি দীপ একটু ওপরে উঠেই আনুভূমিক ভাবে একে অন্যের বিপরীত দিকে সরে গেল। এর পর দুটি দীপই এক সাথে প্রায় সাত আট ফুট সিধা ওপরে উঠে আবার পরস্পরের দিকে এগিয়ে এসে খুব কাছাকাছি চলে এল ।
মনে হল যেন একটা সাত আট ফুটের মানুষ দুটো দীপ জমি থেকে দুই হাতে তুলে নিয়ে ওঠাল তার মাথার ওপর রাখবে বলে । কিন্তু ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না ।
বাকি দীপগুলোও ঠিক সেইরকম ভাবে উঠে এল তবে চার পাঁচ ফুটের মত । এই রকম প্রায় সাত জোড়া দীপ দেখা যাচ্ছে ।
সামনের দীপজোড়া সাত আট ফুট উঁচুতে। তার পিছের দীপজোড়াগুলো ক্রমান্বয়ে একটু একটু করে কম উচ্চতার। সব চাইতে পেছনের দীপজোড়া মাটি থেকে প্রায় দু তিন ফুট উচ্চতায়।
যখন তান্ত্রিকের ক্রিয়া শুরু হয় সেই তন্ত্র-সাধনার বইতে এই রকমেরই কিছু অনুষ্ঠানের কথা লেখা আছে বলে আবছা আবছা মনে পড়ছে । হবেও বা। জ্বলন্ত চোদ্দ প্রদীপের নড়াচড়া দেখছি আর মনে আনতে চেষ্টা করছি এর পর সেই বইটাতে আর কি লেখা ছিল।
যদি আমি ধরে নি যে এগুলো তান্ত্রিকের ক্রিয়া তাহলে এরা দলে মোট সাতজন প্রতেকের মাথায় দুটি করে দীপ ।
সামনে সাত আট ফুট লম্বা কাপালিক আর তার পেছনে তার চেলারা । এক জন ছাড়া বাকিরা সবাই চার থেকে পাঁচফুটের । যারা চার পাঁচ ফুটের তারা হয়ত পূর্ণবয়স্ক । কিন্তু সবার শেষে যে আছে সে কিন্তু দু তিন ফুটের মানে সে হয়ত বালক । হয়ত কোনও তান্ত্রিক ক্রিয়ার জন্যই এই বালক ওখানে আছে ।
হঠাৎ সেই তন্ত্রসাধনার বইটার একটা পাতা যেন চোখের সামনে ভেসে এল । আর সেটা মনে হতেই গায়ের সব লোম শিউরে উঠলো। ব্যাপারটা এই রকমও হতে পারে ।
ওই পাহাড়ে এক কাপালিক আর তার চেলা- চামুণ্ডারা তান্ত্রিক ক্রিয়া শুরু করবার বিধান অনুযায়ী মাথায় জোড়া দীপ নিয়ে এক সারিতে দাঁড়িয়েছে। সেই সারিতে সবার শেষে আছে মাথায় দীপক নিয়ে এক বালক যাকে সম্মোহিত করে রাখা হয়েছে নরবলির জন্য ।
হঠাৎ ওই পার থেকে এক পাল শেয়াল কেঁদে ওঠার মত করে খুব জোরে উঁ উঁ উঁ করে ডেকে উঠলো । সেই শুনে খাদের ধার থেকে কর্কশ আওয়াজে ” ট্যাঁ, ট্যাঁ ট্যাঁ” ডাক দিয়ে একটা বড় পাখি উড়ে গেল নদীর দিকে ।
এর আগে অনেকক্ষণ ধরে টুই টুই করে একটা রাতজাগা পাখি ডাকছিল। ভয় পেয়ে সেও এবার চুপ করে গেল। একটা কিছু যে নিষ্ঠুর কাণ্ড হতে যাচ্ছে তা এরাও টের পেয়েছে ।
এবার পাহাড়ের দিকে নজর ফেলতেই দেখি সেই কাপালিকের দল এবার বালকটিকে তাদের মাঝে রেখে পাহাড় থেকে নিচে নামছে একসারিতে বেশ দ্রুত পদক্ষেপে ।
নিচে নামলেই তো খরস্রোতা নদী । তবে কি নদীতেই বালকটিকে স্নান করিয়ে সেখানেই নরবলি দেওয়া হবে? এর পর মুণ্ডহীন বাকি ধড় ভাসিয়ে দেবে খরস্রোতা পাহাড়ি নদীর জলে? ।
এসব দেখে আমি ওয়াচ টাওয়ারের দিকে চিৎকার করে ডাকলাম রাতের প্রহরীদের । প্রথমবার গলা দিয়ে শুধু ঘড় ঘড় আওয়াজ বেরোলো। পরের বারের চেষ্টায় শুকিয়ে যাওয়া গলা থেকে তেমন জোর আওয়াজ হল না ।
“নদীর ওপারে কাপালিকের দল একটা বাচ্চাকে বলি দিতে যাচ্ছে । চল সবাই, দৌড়ে গিয়ে বাচ্চাটাকে বাঁচাই ।”
বড় ওয়াচ টাওয়ার থেকে কোনও সাড়া নেই। আমার এই চিৎকারে তেমন জোর হয়ত ছিল না। কিন্তু নিস্তব্ধ এই রাতের অরণ্যে বহু দূরে ঝি ঝি পোকার আর রাতজাগা পাখির থেকে থেকে ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে।
ঠিক এই সময় আমার রুমের দরজার কাছে স্পষ্ট নূপুরের আওয়াজ শুনলাম । রাস্তার কালো পিচের চাইতে বেশি গাঢ় অন্ধকারে নিজের গায়ের লোমই ঠাহর হচ্ছে না ।
নূপুরের আওয়াজ আমার দরজা থেকে একটু এগিয়েই বন্ধ হয়ে গেল। নাঃ আর নয়, যেইই হোক আর আমার কপালে যা লেখা থাকে থাকুক, এর একটা হেস্তনেস্ত এখুনি করতেই হবে ।
নিজের রুম থেকে বেরবার সময় যে প্রমান সাইজের লাঠিটা হাতে নিয়েছিলাম সেটা বেশ শক্ত করে আঁকড়ে চেপে রেখে চ্যালেঞ্জের সুরে হিন্দিতে বললাম ” কে, কে ওখানে? উত্তর দাও নয়ত লাঠির বাড়ি পড়বে?”
এটা বলেই বুঝলাম একটু আগে সন্ধ্যাবেলায় বাঘের সাথে মোকাবিলা করে সাহস আর গলার আওয়াজ দুটোই বেড়েছে আমার এর সাথে- সাথে আমি চোস্ত হিন্দিতে কথা বলতে পারছি ।
ও পাশ থেকে কোনও সাড়া শব্দ নেই । এবার মারমুখি আওয়াজেই বললাম ” উত্তর দে নয়তো মরবি এবার আমার লাঠির বাড়ি খেয়ে”।
হাতে লাঠিটা ঘোরাতে ঘোরাতে দৌড়ে নিজের রুমের দরজা আন্দাজ করে মারলাম এক বাড়ি, তবে হাল্কা করে। ভয় পাইয়ে দেওয়াই উদ্দেশ্য ছিল । কিন্তু কেউ ককিয়ে উঠলো না বা পালিয়ে গেল না ।
এবার দ্রুত পদক্ষেপে নিজের রুমে এসে অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে বালিসের তলায় রাখা টর্চটা হাতে নিলাম। এই বিদেশি টর্চের পেছন দিকের বোতামে একটু জোরে চাপ দিলে অনেকটা সাইরেনের মতো আওয়াজ হয় আর সেই সঙ্গে জোরালো ব্লিঙ্কারও আছে ।
সুইচ টিপতেই দুধসাদা আলো এসে পড়ল বাথরুমের দিকে । কিন্তু একি! বাথরুমের দরজা ঢা- ঢা করে খোলা। সেটা দেখেই বুকের মধ্যে দামামা বেজে উঠলো। আমি অতি নিশ্চিত ভাবে জানি যে বাথরুমের দরজাটা আমি নিজের হাতে বন্ধ করেছিলাম। তবে ওখান থেকে নূপুরের আওয়াজ পাবার পর টর্চ ফেলে দেখি নি যে সেটা সেই রকমই আছে কি না ।
টর্চ আর লাঠি হাতে নিয়ে রুম থেকে বাইরে বেরিয়েই দেখি টর্চ আর জ্বলছে না। বারান্দায় কেউ আছে বলে মনে হল না। কি মনে হল টর্চের অ্যালার্মের বোতামটা টিপলাম।
বিকট আওয়াজ করে সাইরেন বাজবার সাথে সাথে বেশ জোর আলো জ্বলা নেভা করতে থাকল । আমার রুমের দরজায় কাউকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু টর্চ সিঁড়ির দিকে ঘোরাতেই গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল ।
কাঠের সিঁড়ি থেকে নূপুরের আওয়াজে মনে হচ্ছে কেউ যেন দ্রুত গতিতে কিন্তু ছন্দের সাথে সিঁড়ি দিয়ে নেমে যাচ্ছে। আমি আলোটা সেই দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতেই মনে হল সার্চ লাইটের মত এক জোড়া তীব্র নীল আলো আমার দিকে একবার দেখল। এর পরই আমার টর্চের ব্লিঙ্কার আর সাইরেনের আওয়াজ ক্ষীণ হতে লাগলো । কেউ কি ঘুরে দাঁড়ালো? ওই নীল আলো যেন আসলে তারই চোখ আর সেই চোখ এগিয়ে আসছে ক্রমশই আমার দিকে ।
আমি এবার খুব জোরে চেঁচিয়ে উঠলাম “বাঁচাও, বাঁচাও”। কিন্তু চিৎকার শেষ করার আগেই দেখি নীল চোখজোড়া এবার আমার থেকে হাত খানেক দূরত্বে ।
আমার মুষ্টিতে জোর করে চেপে ধরা লাঠিটা আর অন্য হাতে ধরা টর্চটা কেউ যেন কেড়ে নিল আর সেগুলো সিঁড়ি দিয়ে গড়াতে লাগলো ।
এইটুকু বুঝতে পারলাম যে আমি এবার লুটিয়ে পড়ছি বারান্দার মেঝেতে আর সিঁড়িতে এবার অনেক গুলো ভারি পায়ের আওয়াজ শোনা যাচ্ছে । সেই আওয়াজে নীল চোখ জোড়া যেন সরে যাচ্ছে ।
ভোরের আলো আর দোয়েলের শিষ ঘুম ভাঙ্গিয়ে গেল। চোখ খুলে দেখি আমি আমার রুমের বিছানায় নেই। ধড়মড় করে বিছানা ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে দেখি আছি গেস্টহাউসেই তবে আমার আগের রুমের পর একটা রুম ছেড়ে ।
যে ঘরটায় অনেক লোকের ফিসফাস শুনেছি সেই রুমে এখন বিশাল কিম্ভুতকিমাকার তালা ঝুলছে। রুমের সামনেটায়, প্রচুর ধুলো। মনে হচ্ছে বহুকাল যেন এই রুমের দরজা খোলা হয় নি । কিন্তু তা তো হতে পারে না। আমি তো কাল রাতেই এই রুমের মধ্যে অনেক লোকের ফিস-ফাস, কাচের বাসনের তুং তাং, এমন কি এক দুটো গেলাস ভাঙ্গবার আওয়াজও শুনেছি ।
ঘরটা দেখে বাইরের বারান্দার দিকে ফিরব ফিরব করছি, দেখি, মনিরাম সিং, টিকোজি দিয়ে ঢাকা এক পট চা এনেছে। একটু আগে কালকের রাতের আমার অজ্ঞান হবার পরের বৃত্তান্ত ওর মুখে শুনে নিয়েছি। ও আর ওয়াচ টাওয়ারের লোকজনেরা দৌড়ে না এলে আমি হয়তো অজ্ঞান অবস্থাতেই বারান্দাতেই পড়ে থাকতাম কতক্ষণ কে জানে?
ধুলোমাখা ঘরটার দিকে ইসারা করে আমি জিগ্যেস করলাম “সুবেদার জী ওই ঘরে কেউ আসে নি নাকি অনেক দিন?” ।
সুবেদার মনিরাম চা ঢালছিলো, সেটা পেয়ালা ছাড়িয়ে প্লেটের বাইরেও ছলকে পড়ল। সে সব কিছু ঠিক করতে করতে ও বলল ” এই রুমের দরজা খোলা বা তার আশপাশেও হাত লাগানোও বারণ আছে”।
কিন্তু আমি এই রুম থেকেই কালকের রাতে যে অনেক লোকের ফিসফাস আর কাঁচের বাসনের আওয়াজ শুনেছি সেই কথা মনে হতেই একটা শীতল স্রোত আমার শিরদাঁড়ায় উঠে আসছিল।
মনিরাম আমার কথা শুনে নিঃস্পৃহ গলায় বলে” স্যার একটু পরে আপনাদের মিটিং আছে ডি এফ ও সাহেবের সাথে। ক্যাপ্টেন সাহেবও আসবেন। ওনাকেই জিগ্যেস করবেন”।
ক্যাম্প প্রশাসক অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন প্রতাপের নাম আগেও শুনেছি। শুনেছি উনি নায়ার স্যারের ডান আর বাঁ হাত দুটোই। মন পড়ে রইল মিটিঙের পরে কিভাবে ক্যাপ্টেনকে একা পাওয়া যায় আর তালা দেওয়া রুমের রহস্যটা জানা যায় ।
কালকে দূরের পাহাড়ে মাথায় এক জোড়া জ্বলন্ত প্রদীপ নিয়ে কারা নামছিল? গেস্ট হাউসের আমার রুমের লাগোয়া চান-ঘরে সেই নর্তকী কে? ক্যাপ্টেন কি এদের দেখেছে বা কারো কাছে এদের কথা শুনেছে? এরা শরীরী না অশরীরী সেটা কি ওর বা এই ক্যাম্পের কারো জানা আছে?
চার
অরণ্যের আবাস
বিদেশে মানুষ থাকে কিন্তু দেশে ফেরবার সুযোগ পেলেই তার মন প্রান আনন্দে নেচে ওঠে। কিন্তু তার আদি বাসভুমি অরণ্যে ফিরে যেতে হলে উল্টোটাই হয়।
মানুষ ছাড়া আর যেসব প্রাণীর মাতৃভূমি অরণ্য তারা কিন্তু অরণ্যেই আছে। তারা সেখানে আনন্দের সঙ্গে বসবাস করে। অরণ্যকে ধবংস করে না। ছোট ছোট পাখি থেকে বাঘ সিংহ হাতি সবাইয়ের ক্ষেত্রে এই কথাটা প্রযোজ্য।
এই কথাগুলো নতুন ডি এফ ও সাহেব আমাদের ক্যাম্প ভিজিটে এসে বলছিলেন ।
লোহা পাহাড় পর্বত শ্রেণীর বেশ কিছুটা অংশ জুড়ে রয়েছে সংরক্ষিত অরণ্য। আমাদের কাজের জায়গা তা থেকে সামান্য বাইরে হলেও এখানেও আসে অরণ্যের আদিম প্রাণীরা।
তারা সহিংস বা অহিংস, মাংসভোজী বা তৃণভোজী যাই হোক না কেন তাদের ক্ষতি তো দুরের কথা কোনও ভাবেই বিরক্ত যেন করা না হয় বা কোনভাবেই আরণ্যক পরিবেশের কোনও ক্ষতি না হয় এই কড়ারেই রীতিমত আইনি মুচলেকা দিয়েই কেবল মাত্র খনিজ অনুসন্ধানের জন্য লোহাপাহাড়ের কাজের অনুমতি পাওয়া গেছে ।
নায়ার বাবুর কড়া তত্ত্বাবধানে সেই ব্যাপারে কোনও ফাঁকফোকরও ধরতে পারেন নি নতুন ডি এফ ও বা তার চেলা চামুণ্ডারা ।
তবে নায়ার স্যার পরিবেশ সংক্রান্ত আইন গুলে খেয়েছেন। আইন ও আছে তার ফাঁক ফোঁকরও আছে। গাছ কাটা যাবে না কিন্তু কাজের জন্য বন বিভাগের লোকজন দিয়ে গাছের ডাল কেটে ফেললে তাতে আপত্তি নেই ।
বনবিভাগের প্রশংসা বা নেক-নজর পাবার জন্য বনের মাঝে জায়গায় জায়গায় পুকুর খুঁড়ে তার পাড়ে নুনের বস্তা রেখে দিয়েছেন তিনি ও তাঁর লোকজনেরা ।
অকৃপণ মৌসুমি বর্ষায় আর মাটির নিচের আর্টেজিয়ান ঝরনার দানে বছরভর সেই সব পুকুর ভরা থাকে। এতে প্রাণীরাও তৃষ্ণা আর নুনের চাহিদা মেটায়, ক্যাম্পের আর ড্রিলিং এর কাজের জলের কিছুটা যোগানও এই পুকুরগুলো থেকেই হয় ।
ড্রিলিং ক্যাম্পে কাজ যেমন ভারি হয় তেমনি লোক ও অনেক বেশিই লাগে। বন বিভাগের আপত্তি সংখ্যায় নয়, এত জন লোক একসাথে থাকলে তাদের নিজেদের মধ্যে কথাবার্তার মিলিত হল্লার সাথে প্রত্যেকের রেডিও বা টেপরেকর্ডারের আওয়াজ অনেক দূর থেকেও শোনা যাবে ।
এ ছাড়া সপ্তাহান্তে বা অন্য কোনও সময়ে পানীয়ের সাথে হই হল্লা তো লেগেই থাকবে। এসব আওয়াজে ভয়ে চমকে পালিয়ে যাবে সব বন্য প্রাণী আর গাছ-গাছালিতে বাসা বেঁধে থাকা পাখির দল।
ভয় পাবার তালিকায় শুধু হরিনের পাল বা খরগোশের দলগুলোই নয়, আমরা যাদের নাম শুনলেই ভয় পাই সেই বাঘ, জংলি শুয়ার, ভালুক এরাও আছে। আমরা এদের যতটা ভয় পাই, তার চাইতে শত-গুন ভয় পায় মানুষকে এই তথাকথিত হাড়হিম করা ভয়ঙ্কর প্রাণীরা ।
এই সব কথাগুলো আমাকে বলছিলেন ক্যাম্প প্রশাসক ক্যাপ্টেন প্রতাপ ।
ডি এফ ও বিদায় নেবার পর ক্যাম্প-প্রধান নায়ার স্যার , এনাকেই বলেছিলেন আমাকে ক্যাম্প পুরো ঘুরিয়ে আনতে।
লোহাপাহাড় চুড়োর ঠিক আগে এই জায়গাটা পুরোপুরি সমতল নয় সামান্য ঢাল নিয়ে একটু একটু করে ধাপে ধাপে উঠে গেছে।
ক্যাপ্টেন জানালেন তাঁবুগুলো দুই ধারে ভাগ করা, পাহাড় ধার আর খাদের ধার। প্রতিটি ধারে পাঁচ – পাঁচ করে মোট দশটি করে টেন্টের সারি। আর দুই-ধারের এই সারিকে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়ে চলে গেছে নিচ থেকে ওপর অবধি যাবার রাস্তা।
এই দুই সারি তাঁবুর পর অনেকটা জায়গা ছাড়বার পর অন্য সারি। লোকজনের বেশি আওয়াজে যাতে বন বিভাগ থেকে আপত্তি না আসে সেই জন্য এই ব্যবস্থা।
বর্ষার সময়ে যাতে রান্না বিঘ্নিত না হয় সেজন্য ক্যাম্পের মধ্যে সবার উঁচুতে খাদের ধারে সাঞ্ঝা-চুলা বা সামুদায়িক রান্নাঘর ।
ফিল্ডের কাজ চালাবার জন্য এই ঘরটি একটি অন্যতম জীবন-রেখা। ক্যাম্পের আবাসিকেরাই পালা করে দলে ভাগ হয়ে একে চালিয়ে থাকেন। সাঞ্ঝা চুলায় তাঁবুর জায়গায় টালির ছাদ আর মাটির দেওয়াল । দেওয়ালে সার সার বাঁক লাগানো আছে । ফিল্ডের কাজে বেরিয়ে যাওয়া প্রায় সব দলগুলো কাজের জন্য আলাদা আলাদা জায়গায় যায় ।
কিন্তু দুপুরে আগের থেকে ঠিক করা কোনও পাহাড়ি ঝোরার বা লোহাপাহাড়ের প্রায় সব জায়গাতেই বহমান এক এবং অদ্বিতীয় পাহাড়ি নালা ‘পুরনা পানির” কোনও নির্দিষ্ট জায়গাতে সবাই চলে আসে। সাঞ্ঝা-চুলা থেকে একটা দল বাঁকে করে সেইখানেই দুপুরের খাবার নিয়ে আসে ।

পাহাড়ী নালা পুরানা পানি
রাত নটার একটু পরেই এই জঙ্গলের বন্য প্রাণীদের মধ্যে কারো কারো রোঁদে বেরবার সময় হয়ে যায়। একসাথে অনেক লোক বসে খাবার খেলে তার হল্লা এবং আলোতে বন্য প্রাণীদের চলাফেরাতে অসুবিধে হতে পারে। এ জন্য রাতের খাবার সাঞ্ঝাচুলার লাগোয়া কুঁড়ে ঘরে কিন্তু রাত নটার মধ্যে। এই একই কারনে রাত দশটার পর জেনেরেটর বন্ধ, কোনোরকম আলো বা আগুন জ্বালানো বা হল্লা হাঙ্গামা করা নিষেধ।
ড্রিলিং ইঞ্জিনিয়ার ভি. নাইডু ও তাঁর দলের ওপর এই মাসের জন্য সাঞ্ঝা চুলা চালাবার ভার পড়েছে । ও বলে নায়ার স্যারের আদেশে উনি নিজে এবং প্রতেককেই এই সাঞ্ঝাচুলাতে বছরে দু-তিনবার কাজ করতে আসতেই হবে। আজ ছুটির দিন, সাঞ্ঝাচুলাতে আজ লোকজন সকাল থেকেই ব্যস্ত এমন কি যাদের রান্নার ডিউটি নেই তারাও আজ স্বেচ্ছাসেবী ।
জঙ্গলের পুকুর থেকে তেলাপিয়া আর পাহাড়ি নদী থেকে এসেছে পাঙ্গাস মাছ। লম্বা পাঙ্গাস মাছের পেট পরিস্কার করে তেল মশলা মাখিয়ে তাদের ফাঁপা বাঁশের মধ্যে চালান করে সেই বাঁশের ওপর আর নিচের খোলা মুখে কাঠের লম্বা টুকরো দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফুট-খানেক গভীর আর প্রায় সেইরকমই চওড়া গর্তের এই রকম অনেকগুলো ভাঁটি আছে সাঞ্ঝাচুলার বাইরে ।
এক একটা ভাঁটিতে এই রকম তিন চারটে, পাঙ্গাস মাছ ভরতি ফাঁপা বাঁশের নল ভাঁটিতে ঢুকিয়ে পুরো ভাঁটি কাঠ-কয়লা দিয়ে ভরে ওপরে ও নিচে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
কাঠকয়লার ধিকি-ধিকি আগুনে পাঙ্গাস মাছের নিজের তেল আর মাখানো মশালার মাখামাখির খেলার শেষে বাঁশগুলো বের করে আনা হয়। বাঁশ পুড়ে গেলেও মাছ পোড়ে না। পরম উপাদেয় এই খাদ্যটি ঠিক পরিবেশনের আগে বাঁশ থেকে বার করা হয় ।
ভাঁটিগুলো আর তার পাশে রাখা ফাঁপা বাঁশটুকরো গুলো দেখছিলাম অবাক হয়ে। নাইডু’র কথায় সম্বিত ফেরে। “ একটু পরেই ওই ভাঁটিতেই হবে মাটির সরায় মুরগী রোস্ট” ।
আমি বলি “ তাই নাকি? আগে কখনো শুনি নি” অবস্যি রান্না-বান্নার আমি কি জানি?
নাইডু বলে “ মাটির সরাতে তেল – মসলা মাখানো মুরগির টুকরোগুলো রেখে ঠিক ওই রকম আর একটা মাটির সরা দিয়ে ঢেকে তাদের জোড়ের ফাঁক মাটি দিয়ে লেপে বন্ধ করে সোজা চালান করে দেওয়া হবে ভাঁটিতে । তার নিচ থেকে ওপর অবধি কাঠকয়লা দিয়ে ঢেকে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হবে। বেশি পরিমান দরকার হলে এক সেট সরার ওপর আর এক সেট দেওয়া হয়” ।
ওর এক সঙ্গী বলে “কাজের দিন কিন্তু ভাত, রুটি, দাল, সবজি তাড়াতাড়ি বানিয়ে বাঁক নিয়ে বেরিয়ে পড়ে সাঞ্ঝাচুলোর দল সেদিনের ঠিক করা দুপুরের আহারের জায়গায়”।
পুরানা পানির কোনও পাড়ে খাবার ব্যবস্থা হলে খানিক আগে পৌঁছায় তারা। সঙ্গে রাখা জাল বা গামছা দিয়ে পুরানা পানির ধরা মাছ পরিস্কার করে সামান্য তেল মাখিয়ে একধরনের জংলি গাছের পাতার মধ্যে মুড়ে আগুনে ঝলসে নেয় । পাতা পুড়ে গেলেও মাছ পোড়ে না।
ক্যাপ্টেন প্রতাপ সাঞ্ঝা চুলার কিছু মেরামতি কাজের তদারকে ব্যস্ত ছিলেন ।
নাইডু বলছিল ““সব প্রদেশের লোকেরা আছেন এই ক্যাম্পে কিন্তু নায়ার স্যারের আদেশে সবার রান্নার ব্যবস্থা এক জায়গায়”।
আমি নিজে এখন পর্যন্ত কখনো চাও বানাই নি । নাইডু অভয় দেয় যে আনাড়িদের প্রথমে সহজ কাজ দেওয়া হয়। পরে অন্যদের দেখাদেখি শিখে যায়। ।
দম বিরিয়ানি চড়তে যাচ্ছে দেখে নাইডু এখুনি আসছি বলে সেখানে ব্যস্ত হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর বিরিয়ানির সুগন্ধে চার দিক ভরে গেলেও আমাকে টানছিল অন্য জিনিষ।
কাল রাতে যা দেখেছি সেই জায়গাগুলো একবার দিনের আলোতে দেখে নিতে চাই । বাইনোকুলার নিয়েই বেরিয়েছিলাম। সাঞ্ঝাচুলা ঘরের কাছে খাদের ধার থেকে সামান্য দূরে এসে সেটি চোখে লাগাতেই উপত্যকার গভীর জঙ্গল আর বাঁকা রুপোলী পাতের মত পাহাড়ি নদী পরিস্কার ভাবে দেখা গেল।
পুরো লোহাপাহাড়-শ্রেণী ওলটানো ইংরাজি Y এর মতো। শুরুর দিকে একটু এগিয়েই মাঝে এক বিশাল উপত্যকার ব্যবধান রেখে পূর্ব আর পশ্চিম এই দুই বাহুতে ভাগ হয়ে অনেক দূর এগিয়ে গেছে। উপত্যকার মাঝ বরাবর বয়ে গেছে পাহাড়ি নদী। কাল রাতে এই পশ্চিম লোহাপাহাড়ের কোথাও দেখেছি সেই সারি সারি জ্বলন্ত প্রদীপ আর কাপালিকের দল । কথাটা মনে আসতেই শরীরের সব কটা লোম শিউরে উঠল ।
আমার কাজ প্রথমেই লোহাপাহাড় পশ্চিমে । পাহাড়ি নদী আর ঘন জঙ্গল পার করতে হবে রোজই । হতে পারে এই ঘন জঙ্গলেই কোথাও কাপালিকদের আস্তানা ।
আমার দিকে চেয়ে ক্যাপ্টেন প্রতাপ বললেন “আপনার কাজের জায়গাগুলোতে ঘন জঙ্গল দেখে চিন্তা করবেন না। প্রতিদিন আপনার সঙ্গে যাবে আমাদের জঙ্গল বাহিনী আর তাদের নেতা মংলু সর্দার। এই জঙ্গল বাহিনিতে অন্যদের সাথে সেনা থেকে অবসর নেওয়া কয়েকজন সুদক্ষ সৈনিকও আছেন যারা যে কোনও পরিস্থিতিতে নিজেদের লোকজনকে নিরাপদে রাখতে পারে”।
আমি বললাম “ তার মানে বিপদ হতে পারে?”
ক্যাপ্টেন বললেন “আপনাদের মতো বিজ্ঞানীরা যাতে নিরাপদে নিজেদের কাজ করতে পারেন সেজন্য এই জঙ্গল বাহিনী আপনাদের কাজের অসুবিধে করা ঝোপ-ঝাড় গুলো সাফ করে আর বিপজ্জনক প্রাণীর উপস্থিতি টের পেয়ে আপনাদের সতর্ক করে দেয়”।
পাহাড় থেকে উপত্যকা অবধি চারপাশে কাঁটা তার দেওয়া ক্যাপ্টেন বললেন “ওই কাঁটা তারের বেড়া ছাড়া এই ক্যাম্পের অনেক কিছুই পুরানো রাজার শিকার বাড়ি বা জঙ্গল – মহল”।
অবাক হই আমি “কিন্তু অরণ্য তো সরকারি সম্পত্তি”
ক্যাপ্টেন দূরের পাহাড়ের দিকে নিজের ছড়ি তুলে দেখিয়ে বললেন “আমাদের এখানের ক্যাম্পই নয়, দূরের ওই পাহাড়ের আগের উপত্যকা পর্যন্ত এখনো রাজবাড়ীর সম্পত্তি”
আমার ভ্রু- কুঞ্চন দেখে ক্যাপ্টেন বলেন” ইংরেজের সাথে মহারাজার যে সন্ধি হয় স্বাধীনতার পরে কেন্দ্রীয় সরকারও ভারতভুক্তির সর্ত হিসাবে মেনে নেয়” ।
আকাশের দিকে বারবার তাকিয়ে ক্যাপ্টেন কি দেখছিলেন কে জানে? আমাকে সে দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে উনি বললেন “আমাদের স্টোরের জন্য একটা পাকা বাড়ি দরকার । কিন্তু খনিজ-সন্ধানে পাকা বাড়ির অনুমতি হয় না। এসবের জন্য মহারাজের এই পরিত্যক্ত শিকার বাড়িটি সব দিক দিয়ে আদর্শ ।
নায়ার স্যারকে আসতে দেখে সেদিকে তাকিয়ে ক্যাপ্টেন বলেন ” নায়ার স্যার বর্তমান মহারাজার রোলস রয়েস গাড়িটি ঠিক করে দেন। এর পরেই এই শিকার বাড়ি সমেত তাঁর নিজের খাস জমির প্রায় পুরোটাই লিজে দেবার জন্য আমাদের কোম্পানির প্রস্তাবে মহারাজা কিছু শর্তে দিতে রাজি হন”।
বিরিয়ানির সুগন্ধ বয়ে নাইডু আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। শর্তের কথা শুনে বললেন,”শিকার বাড়ি আর তার চারপাশের কোনও পরিবর্তন করা চলবে না। মহারাজের পরিবার যখন খুশী এই গেস্ট হাউসে এসে থাকতে পারেন । এছাড়াও …”
নায়ারস্যার আমাদের কাছে চলে এসেছিলেন। উনি বললেন ” গেস্ট হাউসের ওপরের একটা ঘরে রাজ আমলে খানা পিনা এমন কি নাচের আসর ও বসতো । এই ঘরটি কোনও মতেই খোলা যাবে না বা কোনো অতিথিকে দেওয়াও যাবে না” ।
ক্যাপ্টেন বললেন ” মহারাজা নিজেও তন্ত্র সাধনা করতেন। গেস্ট হাউসের প্রধান ফটকের পাশেই পঞ্চবটীর তলায় মহারাজা প্রতিষ্ঠিত কালী মন্দির।এই মন্দিরে নিত্যপুজা এবং বিশেষ পুজোর ব্যবস্থা এবং খরচ লিজের শর্তানুযায়ী কোম্পানি বহন করে” ।
নায়ার স্যার বললেন ” অন্যান্য কালী মন্দিরের মত এখানে ভৈরব নেই। কালী মূর্তির পাশেই একটি কালো বিশাল পাথর আছে । এই পাথরও পুজো পান একসাথে ” ।
ক্যাপ্টেন বললেন “স্থানীয় আদিবাসিরা বলেন পঞ্চবটীর তলায় এই শিলা প্রাচীন কাল থেকে ছিল। ইনিই আদি দেবী।”
“তবে” নায়ার স্যার বলতে গিয়েও থেমে গেলেন । কি ভেবে বলতে শুরু করলেন” লোহা পাহাড় পশ্চিম মানে পাহাড়ি নদীর পশ্চিম পাড়ের পাহাড়চুড়োতে এক শিব মন্দির আছে। আদিবাসিরা বলে দেবীর ভৈরব সেখানেই থাকেন শুধু বিশেষ পুজোর দিন নেমে আসেন দলবল সমেত। কাল রাতেই ছিল সেই বিশেষ পুজো।”
আমি কাল রাতে দূর পাহাড়ে যা দেখে ছিলাম তার সাথে নায়ার স্যার যা বলছেন তার যোগসূত্রটা কিছুটা আন্দাজ করবার চেষ্টা করলাম।
নায়ার স্যার আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু আকাশে কিছু একটা দেখে বলে ওঠেন “ক্যাপ্টেন, দেয়ার দে কাম”।
দুজনে মিলে এক বিশেষ তালে আকাশের দিকে ঊর্ধ্ববাহু হয়ে হাতজোড়াকে এদিক ওদিক করতে করতেই আকাশ থেকে নেমে আসে একটি বাজ আর তার দেখা-দেখি এক ঝাঁক সাদা রঙের গোলা পায়রা ।
বাজ নায়ার স্যারের কাঁধে এসে আর পায়রাগুলো সাঞ্ঝাচুলোর আঙ্গিনায় বসে।
বাজের জন্য মাংস আর পায়রাদের জন্য গম আর শস্যদানা আঙ্গিনায় ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এর মাঝেই ওদের প্রতেকের পায়ে বাঁধা তাড়া-তাড়া খাম খুলে নিয়ে নায়ারস্যারের কাছে দেওয়া হল ।
বাজ বা পায়রা চিঠি নিয়ে আসে এসব এত দিন সিনেমায় দেখেছি। সেগুলো চাক্ষুষ দেখতে পেয়ে আমার চোখদুটো ছানাবড়ার মতো বড় হয়ে উঠলো।
ম্যথিয়াস আমার অবস্থা দেখে বলে “এই বাজ, আর তার কড়া পাহারায় একঝাক পায়রা ভোর বেলা দশ নম্বর পাহাড়ে গিয়ে ওদের কাছ থেকে রিপোর্ট আর খুব দরকারি কতগুলো জিনিসের লিস্ট নিয়ে ফেরত এসেছে”।
ক্যাপ্টেন প্রতাপ পাখিগুলোর কাছ থেকে এসে বললেন “সার্ভে আর ম্যাপ বানাবার জন্য দূরের পাহাড়ে ছোট ছোট ক্যাম্প আছে। এদের কারো রেডিও সেট বিগড়ে গেলে তখন এই বাজ আর পায়রাগুলো তাদের কাছ থেকে রিপোর্ট নিয়ে আসে। দশ নম্বর পাহাড়ে এখন জেনেরেটর বিগড়েছে, তাদের রেশন ও নেই। আমরা বাজের পা থেকে খাম খুলে এটা পড়ার সাথে সাথে রেডিও মেসেজ করে দিয়েছি বেস ক্যাম্পকে। তারা হয়ত এতক্ষণে ট্রাকে মেকানিক আর রেশন পাঠিয়ে দিয়েছে” ।
নায়ারস্যার রিপোর্টগুলো তার সহকারির হাতে ধরিয়ে দিয়ে আমাকে বলেন “ আহত হয়ে এই বাজ আমাদের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল । সেরে ওঠার পর আর ফিরে যায় নি নিজের দলে। সেই সময় ওয়্যারলেস সেট গুলো খুব বিগড়ে যেত। বিভিন্ন পাহাড়ের খবরাখবর, রিপোর্ট পাওয়া নিয়ে বেশ সমস্যা হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন আর তার লোকজন এই বাজ আর তার সাথে এক ঝাঁক পায়রাকে ডাক নিয়ে আসার জন্য ট্রেনিং দেয়। এরা মানুষের চাইতেও তাড়াতাড়ি শিখে নেয় আমাদের ইসারা যে সকালে কোন ক্যাম্পে গিয়ে ডাক আনতে হবে”।
সেই সময়ে প্রত্যন্ত জায়গাতে অয়ারলেস সেট ছাড়া যোগাযোগের আর কোনও উপায় ছিল না।
আমাদের কথায় কথায় দুপুর নেমে আসে। ক্যাম্পের অধিবাসীরা সাঞ্ঝাচুলা ঘরে আসতে শুরু করছেন আহারের জন্য।
ক্যাপ্টেন আমার সাথে আলাপ করিয়ে দিলেন ক্যাম্পের ল্যাবরেটরির কেমিস্টের ।
প্রকৃতিপ্রেমী কেমিস্ট মনসুখ দারুন হাসিখুসি, বললেন “ মহুয়া ফুল আর কমলালেবু থেকে সুধা আর সালফির রস থেকে বিয়ার বানিয়েছি। পাহাড়ে সারাদিনের নামাওঠার পর করে এই সুধা খেলে গায়ের ব্যথা আর থাকে না। আজ সন্ধেয় পাঠিয়ে দেব। আপনার তাঁবু কোনদিকে?”

খাদের ধারে আমার তাঁবু
মনসুখের কথায় মনে পড়ে গেল ম্যথিয়াস একটু আগেই বলে গেল নায়ারস্যার ওকে বলেছেন যে আমার আপত্তি না থাকলে আমার তাঁবু খাদের ধারে নতুন সারিতে হতে পারে। নতুন সারি মানে আমার প্রায় পঞ্চাশ মিটার পেছনে পুরানো সারি এবং আমার আগে আর কোনও তাঁবু নেই।
নিজের অজান্তেই যে একটা দারুণ ঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি সেটা বুঝলাম রাত যখন গড়িয়ে গভীর হল। পরিষ্কার আকাশে তারার সামিয়ানার তলায় টেন্টের লাগোয়া উঁচু গাছের মগডালে টাঙ্গানো হ্যামকের দোলনা বিছানা থেকে পাহাড়ি ঝোরার গর্জনের সাথে আরও অনেক কিছু শোনা আর দেখা গেল ।
সবই অবশ্য নাইট ভিসন দূরবীনের সৌজন্যে । রাতের অরণ্যের এই মায়াবি পরিবেশ ক্যাম্পের আর অন্য কোথাও তাঁবু লাগালে হয়ত পেতাম না ।
দু বছর ধরে সেই খাদের ধারেই নিভৃত এক কোনে আমার তাঁবু লাগানো ছিল এবং তাই বলেই বোধ হয় আমার জীবনে এই প্রথমবার একটা গভীর প্রেমের তুফান বয়ে যায় ।
সে প্রেম আরণ্যক প্রকৃতির সাথে । নদী, ঝরনা আর পাহাড় দিয়ে তৈরি তার প্রতিটি অঙ্গের সাথে। তবে এই সাথে মুখোমুখি বেশ কয়েকবার দেখা সাক্ষাৎ হয়ে গেছে গাছের ডাল থেকে ঝুলন্ত পাইথনের সঙ্গে, মানকচু বা খামআলু খুঁড়তে আসা বুনো শুয়ার বা মহুয়া তলায় ভালুকের সাথে । একবার এক নরখাদক বাঘের সাথে লুকোচুরি খেলায় প্রাণ বাঁচিয়ে ক্যাম্পে ফিরেও এসেছি।
জঙ্গলে একটা বহুল প্রচলিত কথা “ প্রাণঘাতী বিপদ যখন তোমার সামনে আসবে তখন তুমি ভয় পেতে ভুলে যাবে”।
হয়ত এই জন্য কিংবা অরন্যের সাথে আমার গভীর প্রেম দেখে ভয় আর আসে নি । সেই প্রেম এখনো চলছে আমার সাথে । অরণ্যে এখনও আমার আবাস টিকে আছে মনের মণিকোঠায়।
(এই উপন্যাস বাস্তব ঘটনার ভিত্তি তে রচিত কল্পকাহিনি মাত্র।সত্যকার কোনো স্থান বা চরিত্রের সাথে সাদৃশ্য নেই । আলোকচিত্রগুলি লেখক দ্বারা গৃহীত এবং বিভিন্ন অরন্যের।)
Facebook Comments