আদি অন্ত ও অন্যান্য

আদি মানব জন্মের সাড়ে পাঁচ কোটি বছর আগে ,কেমন ছিল এই জগৎ যখন সে জন্ম নিল ,উড়ে বেড়ালো ফুলে ফুলে। এ যেন এক রূপকথার জগৎ। মানব-হীন প্রকৃতির ভিতর সেই অশ্রুত গান তখন কে শুনতো কে জানে। চারপাশ দুধে ধবধবে ,নিঝুম ,এমন পুরীর মধ্যে লোকজন নেই। কোন কিছুর সাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা। এমনকি পাতা পড়ার টুঁ শব্দটি অবধি নয়। যেন সবই পাথর। থেকে থেকেই শুধু পাখ পাখালির টুং টাং। যেন কারো চোখের পলক পড়েনা ,চুল নড়ে না। মুখে কারও ভাষা নেই। ঘুমের দেশে কেবল গুনগুন শব্দ ওঠে আর মিলিয়ে যায় কোথায়। শুধু রাতের অন্ধকারে শত শত আলোক বিন্দু মহাকাশের শুণ্য বুকে ঝুলে থাকে যার এক পাশে হেলে আছে সোনার প্রদীপে ঘিয়ের বাতি। যেন একসাথে জ্বলছে কত রকমের ধন রত্ন , কত হীরা , কত মানিক , কত মতি । উপচে পড়ছে । সেই মায়াবী আলোর ভিতর চারপাশ তখন হাজার হাজার ফুলের গন্ধে বিভোর। কোথা থেকে আসে এমন ফুলের গন্ধ ? লাখে লাখে পদ্ম ফুল ফুঁটে উঠে ম-ম করছে। জোৎস্নয়ার উত্তাপে উপচে পড়তে চাইছে নির্মল মধু।

ক্ষুদ্র পাখাওয়ালা প্রাণ নিভে আসতে চাইছে খুব দ্রুত। ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে তার জীবন। পৃথিবীর আলো যতদিন লেপ্টে থাকতো চোখে , এখন এক অদ্ভুত নিকষ-কালো হয়ে উঠতে চাইছে সেই দৃষ্টি মায় সমস্ত প্রাণ। যে গৃহমুখী ,যে বাহির পানে চলেছে ,উভয়ই হয়তো পৌঁছাতে পারবে না কোথাও । যখন পাখা ভারী ও শ্লথ হয়ে আসবে ওরা ঢুলে পড়ে মিশে moumachiযেতে চাইবে মাটিতে ধুলো হয়ে ।
শেষ শতাব্দীর প্রথম দিকে প্যারিস আন্তর্জাতিক মৌমাছিপালক কংগ্রেসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল , কর্মী ও পুরুষ মৌমাছিদের গড় আয়ু সাধারনত বছরখানেকের একটু বেশি। আর রানী মৌমাছি প্রায় ৭-৮ বছর বেঁচে থাকতে পারে। তবে সাম্প্রতিক কালের গবেষকেরা বলছেন, এখন একবিংশ শতাব্দীতে মৌমাছিদের গড় আয়ু আগের তুলনায় অনেকটাই কমেছে। কর্মী ও পুরুষের গড় আয়ুষ্কাল বর্তমানে ৪৫-৬০ দিন আর রানীর ক্ষেত্রে ৩-৪ বছর।

২ II

মধুস্রোতা ওই দেশটির নাম ইউক্রেন । মধু উৎপাদনে ও আধুনিক উপায়ে মৌ চাষে অগ্রগণ্য। আধুনিক দুনিয়ার প্রথম বিশ্বযুদ্ধ আর রাশিয়ায় জারের বিরুদ্ধে জনগনের হৈচৈ মৌমাছিকে সন্দেহাতীত ভাবে নিদারুণ ক্ষতিগ্রস্ত করে । পরবর্তীতে লেনিনের নেতৃত্বে সারা সোভিয়েতে রাষ্ট্রীয় যৌথ খামার প্রথায় মৌচাষের নীতি গ্রহন করা হলেও সে ক্ষতি পূরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি । লেনিন রীতিমত ফতোয়া জারি করে মৌচাষে জনগনকে উৎসাহিত করেন। ফলে অচিরেই সোভিয়েতে মৌচাষ তিন-চার গুন বৃদ্ধি পেয়ে খামারের সংখ্যা প্রায় কোটিতে পৌঁছায় মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই। কিন্তু ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় আবার ক্ষতিগ্রস্থ হয় মৌচাষ। কিন্তু অচিরেই সোভিয়েত মৌচাষে চলে যায় পৃথিবীতে প্রথম সারিতে।কৃত্রিম উপায়ে এই কাজ কাজ শুরু হলে নির্বিচারেএই ছোট্ট প্রাণ একটু রেহাই পেতে শুরু করে আর সোভিয়েতের সেই প্রযুক্তি ছড়িয়ে পড়ে দেশে বিদেশে। যুদ্ধ শুধু মানুষের ক্ষতি করে না, ছোট ছোট কীট পতঙ্গরাও ক্ষতিগ্রস্থ হয় প্রবল, যেমন ক্ষতি করে দূষিত বাতাস , অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ।

৩ III

ছোট্ট প্রাণ,কি ভাবে যে ঢলে পড়লো চোখের সামনে,দু পা এগোবে ,মুখ থুবড়ে পড়লো মাটিতে ধুলোর ভিতর,পাখনা মেলে উড়ে যাবে ভারী হয়ে উঠলো শরীর,গলা জ্বালা করছিলো হয়তো ,জল খাবার ইচ্ছা করছিলো হয়তো,এমন এনেকেই জলের চারপাশে এসে ডুবে যায় মরণের ভিতর,
কে বিষ মিশিয়ে দিলো কে জানে। …মানুষ ছাড়া কে হবে? কে …

মৌমাছি-প্রজাপতির দল পরাগ মিলনের সব থেকে বড় কারিগর। তারা নিজেদের মধু সংগ্রহ করার জন্য এক ফুল থেকে আরেক ফুলে বসে ।তখনই পুরুষ ফুলের পরাগ রেণু তাদের পায়ে লেগে যায়।যা আবার যখন তারা স্ত্রী ফুলের ওপর বসে,তখন তাদের পায়ের পরাগ রেণু সেই স্ত্রীফুলের গর্ভমুণ্ডে পড়ে,ঘটে যায় পরাগমিলন-এই সকল পতঙ্গের অজান্তেই। চাষীরা জানে যে, এর ফলে বীজের সংখ্যা ও পরিমাণ বাড়ে,ফল ঝরা বন্ধ হয়।ফলন বাড়ে দ্রুতগতিতে।একথা বাংলার চাষীরা জানেনা কেন কে জানে ? বাংলার চাষীরা মনে করে মৌমাছি ফসলের সব ফুল খেয়ে নেবে,চাষীরা মৌ পালককে সন্দেহের চোখে দেখে।
মৌমাছি না থাকলে কুমড়ো, লাউ, বেগুন, পটল, তরমুজ, ঢ্যাঁড়শ, পাতিলেবু, কমলালেবু, আপেল, নারকেল, পেয়ারা, আঙুর, আম, পেঁপে, সর্ষে , ধান এই সব ফসল কবে উধাও হয়ে যেত।

এই সকল ফসল আরো ভালো করে ফলাতে কৃষকরা জমিতে সার দেন। আগে অনেক বেশি ব্যবহার করা হত বিভিন্ন জৈব সার- গোবর সার, কেঁচো সার ইত্যাদি। কিন্তু ফলন বাড়াতে বর্তমানে বেশি ব্যবহার হচ্ছে রাসায়নিক সার, আর তার সঙ্গে ফসলকে পোকামাকড়ের হাত থেকে বাঁচাতে এন্তার ব্যবহার হয়ে চলেছে কীটনাশক। অধিক ফলন আর অধিক লাভের আশায় দেদার কীটনাশক প্রয়োগে এদেশের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু এই কীটনাশকের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া যে কি ভয়াবহ রূপ লাভ করে, তা নিয়ে কেউ চিন্তা করে না। আর তাই, ফল হয় সাংঘাতিক।

সর্ষে ক্ষেতে গুনগুন করে বেড়াচ্ছে মৌমাছির দল। তারপরে আহ্বাদে মধু খেতে বসছে ফুলের ওপর। কিন্তু তারপরই ঘটছে অঘটন। ফুলের মধু খেয়ে ফুলের উপরেই ঘুমিয়ে পড়ছে মৌমাছির দল, কাঁপছে প্রজাপতির ডানা। বেগুন ফুলে বসে মৌমাছিরা আর উড়ছে না। পরাগ মিলনে ঘটছে বিচ্যুতি। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়েই আঙুল উঠেছে কীটনাশকের দিকে। বিভিন্ন পোকামাকড়ের হাত থেকে ফসলকে রক্ষা করতে ঢালাও কীটনাশক ছড়ানো হচ্ছে ফসলে। এতেই বন্ধু পতঙ্গ হচ্ছে কাবু। তাদের ঘ্রাণশক্তি কমছে। কমছে ওড়ার ক্ষমতা।মধু ও পরাগে মিশে যাচ্ছে সেই গরল , এমনকী তাদের মৃত্যু পর্যন্ত হচ্ছে । বাগানে, বাক্সে চাষ করা মৌমাছিগুলো ফুলের মধু নিয়ে আর বাসায় ফিরছে না। ফলে প্রতিদিনই বাক্সের মৌমাছির সংখ্যা তলানিতে ঠেকছে। পরিণামস্বরূপ যেসব ফসলে বাহক নির্ভর পরাগ মিলন জরুরি, সেখানে ফলনে পড়ছে টান। মৌমাছি প্রজাপতি ইত্যাদি পরাগ সংযোগকারী পতঙ্গের সংখ্যা দিন দিন কমতে বসেছে কীটনাশকের নাশকতায়। এমনকি তাদের জীবন কমে আসছে দ্রুত গতিতে। কীটনাশকের গন্ধে তারা আর ফুলে বসতে চাইছে না, তাদের ঘ্রাণশক্তিও কমে যাচ্ছে। কড়া কীটনাশকে দেহের অক্সিজেনে টান পড়েছে, হারাচ্ছে ওড়ার ক্ষমতা , ধীরে ধীরে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছে মধুকরের দল।

অধিক ফলনের আশায় উন্নত জি এম ও বীজ ব্যবহার করা হয়েছিল পাঞ্জাব ,হরিয়ানা ও গুজরাটে। তুলো চাষকে আরো লাভজনক করে তুলতে। ছোট পতঙ্গের সাথে সাথে মানুষ অবধি রেহাই পায়নি এক্ষেত্রে।
সংবাদ পত্রে প্রকাশিত এক খবর অনুসারে পাঞ্জাব আর হরিয়ানায় ২০০১ সাল থেকে আজ অবধি লক্ষ টন কীটনাশকের প্রয়োগ হয়ে গেছে। আজ তাই দুটি প্রদেশের মানুষেরা ভয়ঙ্কর ক্যান্সারের কবলে । এখানকার মাটিতে ক্যান্সারের কারণ হতে পারে এমন উপাদান তাই ভরপুর।ভাটিন্ডা থেকে বিকানের চলাচল করা দৈনিক এক ট্রেনের নাম এখন ক্যান্সার ট্রেন। নামেই সে পরিচিত।
ক্যান্সার ট্রেন এক এমন ট্রেন ,যাতে প্রতিদিন যাতায়াতকারী যাত্রীর ৭০-৭৫% মানুষ ক্যান্সার রোগগ্রস্ত । প্রতিদিন সেই ট্রেনে ৬০০ মানুষ শুধু এই চিকিৎসার জন্যে যাতায়াত করে থাকে। সরকার কিছু কীটনাশক ওষুধের উপর প্রতিবন্ধকতা চালু করেছে যা কিনা ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।কিন্তু আক্ষেপের কথা আজও কীটনাশক থেকে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া হয়নি । এর পরিনাম এতটাই ভয়াবহ যে এখন প্রতি পরিবার পিছু কেউ না কেউ এই ক্যান্সার রোগের শিকার।

বিকানিরের আচার্য তুলসী ক্যান্সার হাসপাতালে এমন রোগের উপাদান পাওয়া যাচ্ছে । চন্ডিগড়ের এক হাসপাতাল ২০০৫ সালের এক রিপোর্টে জানিয়েছে যে মানুষের রক্তে অধিক পরিমানে কীটনাশক পাওয়া যাচ্ছে । বলা ভালো এটাই ক্যান্সার হবার আগাম সতর্ক বাৰ্তা । এর পরেও আরো এক রিপোর্টে এমন সতর্কতা জারি করা হয়েছিল। কিন্তু কোনো সরকারই এই রিপোর্ট কে গুরুত্ব দিতে নারাজ ।
সারা বছরে প্রায় ৫০ হাজার ক্যান্সার রোগী এই দুই রাজ্য থেকে এখানে চিকিৎসার জন্যে এসে থাকে। প্রতিদিন ১০০-১৫০ টা বাচ্চাও এই হাসপাতালের আউট ডোরে এসে থাকে যারা কিনা ফসলে ব্যবহৃত অধিক পরিমানের কীটনাশকের স্প্রের থেকে কোনো না কোনো ভাবে প্রভাবিত। এখানেই সবাই আসে কেননা তুলনা মূলক ভাবে এখানে চিকিৎসার খরচ কিছুটা হলেও কম। এই সব কিছুর পেছনেই জি এম ও কাপাসের এক এবং একমাত্র অবদান। এখন যদি জি এম ও সর্ষে আমাদের দেশে চলে আসে তাহলে অনুমান করে নিতে অসুবিধা হয় না আগামী চেহারা আমাদের জন্যে কি নিয়ে অপেক্ষা করে আছে। কেননা প্রতিটি ঘরে ঘরে সর্ষের শাক , সর্ষের তেল ও খোল যা কিনা মানুষ ও গবাদি পশুরা খেয়ে থাকে। এই বিষ শুধু ছড়িয়ে পড়ার অপেক্ষায়। রান্না করা খাবার থেকে , গবাদি পশু খেলে তার দুধের থেকে এমনকি শুকিয়ে যাওয়া ফসল জ্বালানী হিসেবেও ব্যবহারে বিপদের সংকেত পাওয়া যাবে।

 

অলংকরণ : সমীরণ মন্ডল

Facebook Comments