সকাল সাতটার ফোন

কাজের ফাঁকে ফাঁকে বারবার চোখ চলে যাচ্ছে সেল ফোনটার দিকে| প্রতিদিন সকালে নিয়ম করে বেজে ওঠে সেলটা| কিন্তু আজ এখনও বাজল না তো? দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সেমন্তী| সাতটা বেজে পাঁচ| প্রতিদিন দেওয়াল ঘড়ির কাঁটা সাতটা ছুঁই ছুই সেলফোনটা বেজে ওঠে| বেশ কিছুদিন ধরেই ঠিক সকাল সাতটায় সেলফোনের বেজে ওঠাটা কেমন যেন একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে| সকালবেলা আর পাঁচটা প্রাত্যহিক কাজের মত সেলফোনের বেজে ওঠাটাও খুব জরুরী| না বেজে উঠলেই মনে হয়‚ কি যেন আজ একটা বাদ গেছে| ঠিক এখন এমনই একটা অনুভুতি হচ্ছে সেমন্তীর| বারবার নিজের অজান্তেই চোখ চলে যাচ্ছে দেওয়াল ঘড়ির দিকে| দেওয়াল ঘড়িটাও কেমন যেন ছুটে চলেছে সমুখপানে| আজ যদি ঠিক সাতটাতেই ঘড়িটা বন্ধ হয়ে যেত তবে তো এত উৎকন্ঠা হত না তার| কিন্তু ঘড়িটা একঘর একঘর করে কখন যেন সাড়ে সাতটার ঘর পার করে গেছে|

কি গো আজ কি চা দেবে না? অনন্ত এসে দাঁড়ায় রান্নাঘরের দরজায়| একদম বাঁধা সময়| সাড়ে সাতটা মানে সাড়ে সাতটাই| ঠিক সাড়ে সাতটাতেই প্রতিদিন চা দেয় সেমন্তী অনন্তকে| কিন্তু আজ কেন যেন সব গড়বড় হয়ে গেছে| চায়ের জলটা চাপিয়েছে ঠিকই‚ কিন্তু সেই জল যে কিছুতেই ফুটছে না সেটা এতক্ষণ ধরে খেয়ালই করেনি সে| ভেবেছিল ওভেনটা ধরিয়েছে‚ কিন্তু গ্যাস ওভেনে চায়ের বাটিটা বসিয়ে যে আঁচটা দিতেই ভুলে গেছে‚ এতক্ষণে সে খেয়াল হল|

দিচ্ছি‚ তুমি ঘরে যাও| চায়ের জল চাপিয়েছি‚ ফুটে গেলেই দিয়ে আসছি|

ভালো‚ পেলেই ভালো‚ তবে চায়ের জল যে আদৌ ফুটবে বলে তো মনে হয় না| আমি তবে ঘরে গেলাম| বলে অনন্ত চলে যায়|

কি সাঙ্ঘাতিক শকুনের চোখ| ঠিক দেখে নিয়েছে যে সেমন্তী ওভেন জ্বালাতে ভুলে গেছে| হাড় জ্বালিয়ে খেল| তাড়াতাড়ি করে ওভেনটা জ্বালিয়ে নিয়ে চটপট চা করে ফেলে| চা টা ছেঁকতে ছেঁকতেই আরও একবার নিথর সেলফোনটার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে| নাহ‚ আজ আর বাজলই না| যে কলটা রোজ আসে সেটা আজ আর এলো না| আর ঠিক তখনই মনে পড়ল তার‚ আরে ঐ কলটা তো আর কোনদিন আসবেই না| সেতো নিজে থেকেই ঐ কলটা আসার পথ বন্ধ করে দিয়েছে| এতক্ষণের অস্বস্তি থেকে একটা যেন সাময়িক রেহাই পেল সে| খামোখা সকাল থেকে ফোনটা আসবে মনে করে বসে থেকে কাজে কত না দেরী হয়ে গেল| এতক্ষণে প্রতিদিন কত কাজ হয়ে যায়| নিকুর স্কুলের আর অনন্তর অফিসের টিফিন রেডি হয়ে যায়| ভাতের দুটো তরকারিও নামব নামব করে| আর আজ কিচ্ছু হয়নি| এবার অনন্ত এসে দু চারটে মিষ্টি মধু কানে ঢেলে দেবে| আর সেমন্তী তেলেবেগুনে জ্বলে উঠবে| লোকটাকে দুচক্ষে দেখতে পারে না‚ ঘর জ্বালানে পর ভোলানে| আর এই যে দেখতে পারে না‚ এ থেকেই তো ফোনের অপেক্ষা শুরু| ফোনটা যবে থেকে আসছিল তবে থেকে যেন এইসব তিক্ততাকে আর তিক্ত মনে হত না| বেশ সইয়ে নিয়েছিল সে|

তরকারী কাটতে কাটতে মনে পড়ে যায়‚ বেশ কিছুকাল আগে তাও ঐ মাস ছয়েক হবে হঠাৎ একদিন ঠিক সকল সাতটায় ফোনটা বেজে উঠেছিল| তখন সেমন্তীর আগুনে পড়বে না জলে পড়বে অবস্থা| নিতান্ত তাচ্ছিল্যভরে ফোনটা তুলেছিল| আর তুলতেই যেন কানে মধু ঢেলে একটা পুরুষকন্ঠ জানতে চেয়েছিল কি করছ? জানো কাল সারারাত এক পলকের জন্যও চোখের পাতা বন্ধ করতে পারিনি| খালি তোমার কথা ভেবেছি|

থমকে গেছিল সেমন্তী| সাতসকালে এ আবার কি ধরণের রঙ্গরসিকতা? বেশি কথায় আর না গিয়ে রং নাম্বার বলে কেটে দিয়েছিল| নির্ঘাত কেউ রং-নাম্বারে ফোন করে ফেলেছিল| প্রেমিক নির্ঘাত| আহা কি রোমান্টিক গলার স্বর| প্রথম প্রথম অনন্তর গলাতেও এমন মধু ছিল | তারপর সেমন্তীর সীমান্ত যত চওড়া হতে শুরু করল‚ কথার মধু তত শুকিয়ে যেতে শুরু করল|

পরের দিন সকাল সাতটায় আবার বাজল সেলফোনটা| আবার সেই এক গলা| কাল ফোনটা কেটে দিলে কেন? জানো আমি কত কষ্ট পেয়েছি তুমি আমার সাথে কথা বললে না বলে? আমি কি খুব বাজে কিছু ইঙ্গিত করেছিলাম যে তুমি ফোনটা কেটে দিলে?

একরকম বাধ্য হয়েই কথা বলতে হয়েছিল সেমন্তীকে| কে আপনি?

আমি পার্থপ্রতিম|

ও আচ্ছা| দেখুন পার্থপ্রতিম‚ আমি আপনাকে চিনি না| আপনি মনে হয় অন্য কাউকে ফোন করতে গিয়ে আমায় করে ফেলেছেন| আমার কথা বলার কোন ইচ্ছেই নেই আর সময়ও নেই| তাই কেটে দিচ্ছি| বলে কট করে কেটে দিয়েছিল| আর স্পষ্টতই বিরক্তি অনুভব করেছিল|

আবার পরের দিন সকালে ঠিক সাতটায় সেলফোনটা বেজে উঠল| আবার সেই এক গলা| আজ কিন্তু ফোনটা কেটো না লক্ষীটি| আসলে তোমার সাথে কথা বলতে আমার ভালো লাগে|

তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতে উঠতেই সেমন্তী ব্যঙ্গের স্বরে প্রশ্ন করেছিল‚ তার মানে যে কোন মহিলাকে ফোন করা আর এইসব কথাবার্তা বলা আপনার একটা অভ্যেস বুঝি|

এ বাবা‚ তা কেন হবে‚ আমি তো তোমাকে ফোন করে কথা বলতে চাই| বিশ্বাস কর আর কাউকে আমি ফোন করি না| আসলে সেই যে প্রথমদিন তুমি ফোনটা রিসিভ করলে তারপর থেকেই তোমার গলা আমাকে ভীষণভাবে টানতে শুরু করল| ঘুম থেকে উঠে তোমার সাথে কথা না বলতে পারলে আমার মনে হয় সকালটাই কেমন যেন রঙহীন‚ দিনটা কেমন যেন ম্যাড়ম্যাড়ে| তুমি রাগ করো না প্লিজ‚ রোজ জাস্ট দুমিনিট আমার সাথে কথা বল তুমি‚ তাহলেই হবে| প্লিজ|

এইভাবেই যেন সকাল সাতটার ফোনটার জন্য একদিন সেমন্তীর অপেক্ষা শুরু হল| দুমিনিটের ফোন কখন যেন পনেরো মিনিট অতিক্রম করে গেল| বারবার ভেবেছে সেলফোনটা বন্ধ করে রেখে দেবে‚ কিন্তু কি যে এক অমোঘ আকর্ষণ যে কোনদিনই আর সেটা করে ওঠা সম্ভব হয়নি| কখনও কখনও ভেবেছে নম্বরটা কার সেটা একটা খুঁজে দেখবে‚ আজকাল ফোনের নম্বরের মালিককে খুঁজে বার করাটা কোন ব্যপার নয়| কিন্তু ভাবাটাই সার হয়েছে‚ কাজে আর তাকে পরিণত করা হয়নি| আর নিরীহ ফোন নিয়ে বেশি কিছু মাথা ঘামনোরও কিছু পায়নি|

তবে একথা অনস্বীকার্য‚ এই ফোনের ওপারের ঐ কন্ঠস্বরের প্রতি একটা ভালোলাগা জন্মেছিল| ওপাড়ের কন্ঠটি যখন বলেছিল‚ তোমাকে জান ভীষণ ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে‚ তখন ষোড়শী কিশোরীর মত তার মনটাও নেচে উঠেছিল| একটু একটু করে দুর্বল হয়ে পড়ছিল যেন ঐ কন্ঠস্বরের প্রতি| আর একটু একটু করে ঐ ফোনের কন্ঠস্বরকে নিয়ে আকাশ কুসুম রচনা করতে শুরু করেছিল| সারাটা দিন কেমন যেন নিজের বায়বীয় একটা অবস্থান অনুভব করত| মনে হত মাটিতেই নেই| নিকু‚ অনন্ত সবার প্রতি যেন টানটা আর তত টের পেত না| নিকু এসে কোলে ঝাঁপিয়ে পড়লেও আগের মত কিছুতেই আর স্বাভাবিক হতে পারছিল না| অনন্তও কখন রাতের আঁধারে কাছে টানার চেষ্টা করলে বিরক্ত হত সেমন্তী|

আর এতকিছুর মাঝেই হঠাৎ সেদিন সেই কন্ঠ বলে উঠল‚ জান তোমায় আর ফোন করা হবে না আমার মনে হচ্ছে| তোমার বৌদি না জেনে গেছে| আর তারপর থেকে যে কি অশান্তি হচ্ছে তোমায় কি বলব| কিছুতেই বোঝাতে পারছি না‚ তুমি হলে আমার একটা টাইমপাস| এই পর্যন্ত শোনার পর আর যেন সহ্য করতে পারে নি সেমন্তী| টাইমপাস শব্দটা যেন কানের মধ্যে গরম সীসে ঢেলে দিয়েছিল| যেন হঠাৎ করেই কেউ যেন বাস্তবের মাটিতে নামিয়ে এনেছিল কল্পনার ফানুসটা ফাটিয়ে| একটা অব্যক্ত কষ্ট হচ্ছিল| অথচ কেন যে কষ্টটা হচ্ছিল বুঝতে পারছিল না| খুব কঠোর গলায় কেটে কেটে বলেছিল আগামীকাল থেকে আর যদি ফোন করেছেন তাহলে আমি আপনার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেব| দয়া করে আর ফোন করবেন না| কিছু সময়ের জন্য সেলটা অফ করে রেখে দিয়েছিল| ভেবেছিল হয়ত কলব্যাক করবে কন্ঠস্বরটি| হাকড় পাকড় করে ফোন খুলে খুব আশা নিয়ে তাকিয়েছিল ফোনটার দিকে‚ না কোন কল নেই| খুব কান্না পাচ্ছিল| কখন যেন নিজের মনে নিজের অজান্তেই কন্ঠস্বরটিকে জায়গা দিয়ে ফেলেছিল|

আর সকালে তো একদম ভুলেই গেছিল যে আজ আর ঐ কল আসবে না| মনটা একটু একটু করে খারাপ হয়ে যাচ্ছে| যাবেই‚ তারপর আবার আস্তে আস্তে সকাল সাতটার ফোনের অপেক্ষা একটু একটু করে মিলিয়ে যাবে| ততদিন তো একটু অপেক্ষা করতেই হবে|

Facebook Comments


Tags :