শৈলসুতে
বাবা চলে যাবে আরেকটু পরেই । সবাই বলছে আর আধঘন্টা লাগবে খুব বেশি হলে ।খুব রাগ হচ্ছিল বাবার উপর ।তবু ভীষণ আদর করে বাবার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিল তুলি । আর তো সুযোগ পাবেনা ।মাত্র চারদিনের নোটিশে একরকম চুপ করেই পালিয়ে গেল বাবাটা , কেন কি দোষ করেছিল ওরা ? ও ,মা , ভাইয়া ? স্কুলে কেউ খবর দেয়নি যে বাবা চলে গেছে । বাবার কলিগ সুমিত আঙ্কল বাইকে করে ওকে নিতে এসেছিল দেখেই বুঝতে পেরেছিল অবশ্য । কদিন ধরেই তো এই মূহুর্তটার আশঙ্কায় ছিল সবাই । বাড়িতে তখন বাবা যতটা স্থিরভাবে শুয়ে ,মা তারচেয়েও স্থিরভাবে পাশটিতে বসে । গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে উঠেছিল তুলি , সামলাতে পারেনি । ভয় পেয়ে গেছিল ভাইয়া , কেঁদে উঠেছিল ,মাত্র দেড় বছর বয়স তো ,আহা ! কত্ত ছোট্ট ওর থেকে । কেমন মিট্টি করে ডাকে “এই তিতি !” দিদি বলতেও শেখেনি পুচকুটা ।এইসবের মধ্যে কেউ আর দেখেনি কখন পড়ে গিয়ে কপালে একটা নীল আলু হয়েছে বেচারার । উঠে ভাইকে কোলে তুলে ফ্রিজ খুলে কপালে বরফ দিচ্ছিল ও । ততক্ষণে গাড়িতে উঠছিল বাবা । আর বেসিনে অঢেল বমি করে তুলে দিচ্ছিল মা জোর করে খাওয়ানো ভাতের গ্রাস । পাশের মাঠে বাঁশের গাদা এড়িয়ে দাঁড় করানো সব গাড়ি । আর ঠিক একমাস পর পুজো ।
শ্মশানে পৌঁছতে না পৌঁছতেই অস্বস্তিটা শুরু হয়েছিল তুলির ।কি যেন নামছিল , কি যেন চটচট করছিল ,হড়হড় করছিল । সব মিটে যেতে চেতনা পেল ও ,ঠিক কি হয়েছে ওর । একছুট্টে মাকে জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছিল ।কিন্তু মা তো আসেনি এখানে ,কেউ আনেনি । কখন বাড়ি পৌঁছবে তুলি ……কখন …. কত দূর আর ….ভাবতে ভাবতে মাথা ঢলে পড়েছিল চারদিনের জমানো অবুঝ ঘুমে ।
তারপর কেটে গেছে পুরো একমাস । মা এখনো ঠিক সেরকমই । না বকলে খায় না , খুব দরকার না হলে কথা বলেনা । দাদু-দিদান এসে আছে সেই থেকে এখানেই ।আজ অষ্টমী পুজো । দাদুকে বলে শ্রেয়ানী বাড়িতে নিয়ে গেছে তুলিকে । বেশিদূর না । দুটো গলি পরে । নতুন পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় মাউন্টেনিয়ারিং এর উপর একটা লেখা দেখে আর থাকতে পারলনা তুলি । অজস্র মনখারাপ সত্বেও পড়ে ফেলল । তার জীবনের লক্ষ্যই ছিল পর্বতারোহণ । মাধ্যমিকে ৯০% এর উপর নম্বর পেলে সাহায্য করবে , কথা দিয়েছিল বাবা । বাবার সাথে পুড়ে খাক্ হয়ে গেছে তার ঐ স্বপ্ন , জানে তুলি । তবু অসীম শক্তিতে টানে তাকে পাহাড়চূড়াগুলো ।
একাই বাড়ি ফিরছিল তুলি । অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়া চলছে পাড়ার প্যান্ডেলে । তুলির দুটো কারণে এবার অঞ্জলি দেওয়া বারণ । এক তো কালাশৌচ । তারপর মাসের অস্বস্তিটুকু ঠিকসময়মত এসে হাজির হয়েছে ষষ্ঠীর দিন থেকে । প্যান্ডেলের খুঁটিটুকু একটু আড়াল করে দাঁড়িয়ে পড়ল তুলি । মা দুর্গা হিমালয়নন্দিনী শৈলসুতা , অনেকবার শুনেছে ও , জানে । চুপটি করে মায়ের ঘামতেল মাখা ,বড় নথ পরা মুখে একঢাল কোঁকড়ানো চুলের মধ্য থেকে উঁকি মারা ত্রিনয়নের দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকল ।
একপ্রস্থ অঞ্জলি শেষ । জুতো পরার হৈচৈ এর মধ্যে একটা ছোট ছেলে ঝুড়িতে করে ফুল এগিয়ে দিল তুলির দিকে ।সেকেন্ডের ভগ্নাংশ সময় নিল তুলি ।তারপর হাত বাড়িয়ে তুলে নিল ফুল-বেলপাতা । অঞ্জলি শুরু হয়েছে । পুরোহিতঠাকুরের বলা মন্ত্র কিচ্ছু বলছিলনা তুলি । একমনে মাকে ডাকছিল ,বলছিল – “মাগো , আমাকে খুব তাড়াতাড়ি বড় করে দাও ,আমাকে মা আর ভাইয়াকে দেখে রাখতেই হবে । ” আর বলছিল – “যদি কোনদিন সুযোগ পাই , ঠিক যাব সেখানে ,যেখান থেকে আস তুমি ,ঠিক যাব দেখো একদিন , আমাকেও সেদিন মানুষ পর্বতকন্যা বলে চিনবে “। তুলির বন্ধ চোখের পলক বেয়ে লালচে গাল ছাপিয়ে পার্বত্য ঝর্ণা নামছিল অঝোরে ।
প্যান্ডেলে বর্ষীয়ান পুরোহিতের উদাত্ত কন্ঠের অনুসরণে সমবেত কন্ঠে তখন উচ্চারিত হচ্ছে –
“বন্দিতাংঘ্রিযুগে দেবি সর্বসৌভাগ্যদায়িনী
রূপং দেহি জয়ং দেহি
যশো দেহি দ্বিষো জহি ।।”
Facebook Comments