মা আর রবীন্দ্রনাথ

মা আর রবীন্দ্রনাথ – এই দুজনকে নিয়ে লেখাই বেশ চাপের। সমস্যা হল – মা খুবই বেশী করে আমার কাছের (সবারই)। এতোটাই যে তাকে আলাদা করে আর দেখা হয়ে উঠলো না। আর রবীন্দ্রনাথ আমার কোনোদিনই হন নি। ফলে ‘আমার মা’ বা ‘আমার রবীন্দ্রনাথ’ – এ-ধরণের কিছু লেখা আমার পক্ষে অসম্ভব। কিন্তু কিছু না লিখলে মান থাকে না, তাই …

মায়ের ব্যাপার ছেড়ে রবীন্দ্রনাথে আসি, কারণ উনি আমার মায়ের থেকে অনেক বেশী নাম করেছিলেন বলে আপনারা সবাই তাঁকে চেনেন।

ওঁর লেখা গুটিকয় ছোটগল্প আর কবিতা আমি পড়েছি। ওঁর লেখা আর সুর করা কিছু গান শুনেছি। তবে তা দিয়ে কাজ চলা মুশকিল – আমি মানছি। ফলে, আমার অন্যান্য মৌলিক লেখার মতন এই লেখাটাও নেট-টোকাটুকি করে নামাচ্ছি। আশা করি অন্যান্যবারের মত এবারও আপনাদের সমাদর থেকে বঞ্চিত হব না।

রবীন্দ্রনাথ ও তৎকালীন হেয়ারকাট, রবীন্দ্রনাথ ও রাত, বা পথ, বা জার্মানি, বা শ্বশুরবাড়ি জাতীয় সুচিন্তিত এবং গবেষণা-গম্ভীর লেখা আপনারা যাঁরা প্রকৃত রবীন্দ্রপ্রেমী তাঁরা অনেকেই পড়েছেন। বইমেলায় রবি-ব্যাভিচার-বিশেষজ্ঞ এক নামজাদা লেখককে দেখে পরিচিত কবি শুভাশিস ভাদুড়ি দৌড়ে সামনে গিয়ে হাতের কাছে পেয়ে যাওয়া একটা খবরের কাগজ তুলে চিৎকার করেছিলেন – ‘রবীন্দ্রনাথ ও আমবাত’! ‘রবীন্দ্রনাথ ও আমবাত’! ‘রবীন্দ্রনাথ ও আমবাত’! তবে ‘রবীন্দ্রনাথ ও চুরি’ – এই বিষয়ে আমার এই রচনাই প্রথম, সুতরাং মৌলিক!

টোকাটুকিও এক ধরণের চুরি। তবে এই চুরি করলে দাতার কোনো ক্ষতিসাধন হয় না। তাই এই চুরি অতটা খারাপ নয় যতটা, হে বিদুষী পাঠিকা, আপনি ভাবছেন। আমি আপনার কৃপাদৃষ্টি ভিক্ষা করি!

রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চুরির সম্পর্ককে অঙ্গাঙ্গী বললে খুব একটা অত্যুক্তি করা হয় না বোধ হয়। নলিনীকান্ত সরকারের বইতে পড়েছি, মোহিতলাল মজুমদার কোনও এক বৈঠকে রবিঠাকুরের কোনও কোনও রচনাকে পরস্বাপহরণ বলে দোষ দিচ্ছিলেন। দেখেশুনে শান্ত থাকতে না-পেরে ওই বৈঠকে উপস্থিত নলিনী বলেন যে মোহিতলালের অধিকাংশ রচনাও তবে গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা থেকে চুরি, কারণ ওঁর কবিতায় বসন্ত, গ্রীষ্ম ইত্যাদি শব্দের ব্যবহার রয়েছে! বাউলাগানের সর্বজনস্বীকৃত পণ্ডিত সুধীরবাবুর বইতে পড়েছি, পুণ্যভূমি ছেঁউড়ের কিছু বাউল সাধক না কি অন্তর থেকে বিশ্বাস করেন – লালন সাঁইয়ের গান চুরি করে রবিঠাকুর নোবেল পেয়েছিলেন!

রবিঠাকুরের সঙ্গে চুরির সর্বশেষ মোলাকাত ঘটে তাঁর নিজেরই নোবেল পদকের বদান্যতায়। তবে সে অনেক বড়ো মানুষদের কথা! ও-সব কোনো গোলাপী শার্দূলের জন্য তোলা থাক!

ঘটনাটা ১৯২৪ সালের। রবিঠাকুর বেশ কিছুদিন হল নোবেল পেয়েছেন। বিশ্বজোড়া নাম তাঁর। তবে তারই মধ্যে তিনি বিশেষভাবে জনপ্রিয় লাতিন আমেরিকায়। পেরু সরকারের আমন্ত্রণে ওই বছর তিনি যাচ্ছেন তাঁদের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। পথে, বুয়েনোস আয়ার্স-এ অসুস্থতা এবং ওকাম্পোর সঙ্গে মোলাকাত।
ততদিনে লাতিন আমেরিকার বিদ্বজ্জনের কাছে রবিঠাকুর পরিচিত নাম। ১৯১৩-তে নোবেলজয়ের পরেই ‘প্লাতেরো ই ইয়ো’, বা ‘প্লাতেরো ও আমি’-খ্যাত হুয়ান রামোন হিমেইনেস ও তাঁর মার্কিনি বান্ধবী জেনোবিয়া গীতাঞ্জলী-র অনুবাদ করতে শুরু করেন। এই বই পরবর্তীকালে ‘১৯২৭-এর প্রজন্ম’-কে (যার কয়েকজন নক্ষত্র ছিলেন রাফায়েল আলবেরতি, ভিসেন্তে অ্যালেইকসান্দ্রে আর – ফেদেরিকো গার্থিয়া লরকা), খুব প্রভাবিত করে। ১৯২১-এ স্পেনযাত্রার কথা ছিল রবিঠাকুরের। বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে লরকা ‘বিসর্জন’ নাটকে অভিনয় করা মনস্থ করেন। জয়সিংহের ভূমিকায় লরকা স্বয়ং! কিন্তু সে-যাত্রা শেষপর্যন্ত বাতিল হয়।

ইতোমধ্যে হিমেইনেস-এর অনুবাদের সূত্রে রবিঠাকুরের নাম ছড়িয়ে পড়তে থাকে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশে। চিলিতেও। ১৯৪৫-এর নোবেলজয়ী চিলির গ্যাব্রিয়েলা মিস্ত্রাল রবিঠাকুরের কবিতার সংকলন বের করলেন।

শুধু মিস্ত্রালেরই নয়, চিলির আরও একজন কবির – নামটা তাঁর পরেই বলছি – মাথাও ঘুরে যায় এইরকম সময়ে। কবিজন্মের প্রারম্ভ তখন তাঁর।

১৯২৪-এ তাঁর একটি বই প্রকাশিত হয় – যার ইংরাজী নাম “Twenty Love Poems and a Desperate Song” ।

১৯৩৪ সালে আর্জেন্তিনার প্রো নামের একটি সাহিত্য পত্রিকায় এই বইয়ের ষোলো নম্বর কবিতা নিয়ে শোরগোল পড়ে যায়। কবিতাটা না কি রবিঠাকুরের একটা কবিতার থেকে টোকা! রবিঠাকুরের ‘দ্য গার্ডনার’ বইয়ের ৩০ নম্বর কবিতা – যা নাকি স্প্যানিশে অনুবাদ করেন হিমেইনেস-এর জেনোবিয়া, আর ওই কবির এই কবিতা – এ-দুটো পাশাপাশি ছাপিয়ে এই দাবী করেন ভোলোদিয়া টাইটেলবয়েম।

কেমন ছিল রবিঠাকুরের সেই কবিতা?

You are the evening cloud floating in the sky of my dreams.
I paint you and fashion you ever with my love longings.
You are my own, my own, Dweller in my endless dreams!
Your feet are rosy-red with the glow of my heart’s desire, Gleaner of my sunset songs!
Your lips are bitter-sweet with the taste of my wine of pain.
You are my own, my own, Dweller in my lonesome dreams!…

তুমি সন্ধ্যার মেঘমালা…

আর সেই সদ্য-কবি লিখেছিলেন –

Eres mía, eres mía, mujer de labios dulces
y viven en tu vida mis infinitos sueños.

মানে – You are mine, you are mine of sweet lips and my infinite dreams live in your life (জেসন উইলসনের বইতে যা আছে)।

ঠাকুরের অনুবাদের জেনোবিয়া লিখেছিলেন –

Eres mía, eres mía, y vives en mis suenos solitarios

মানে – You are mine, you are mine and live in my solitary dreams (সূত্র – ঐ)।

পাওলো দে রোখা, ভিসেন্ত ইদোব্রো-র মতন কবিরা এই নিয়ে একেবারে ঝাঁপিয়ে পড়েন। রোখা তো ওই কবিকে একেবারে চোর বলে দেগে দেন, আর বলেন ওঁর সব লেখাই প্রায় চুরি – কখনও টেগোর, তো কখনও বদলেয়ার, রাঁবো, এরকাস্তি! অশান্তি এতোদূর যায় যে ১৯৩৭-এ নতুন সংস্করণ বেরোনোর সময় ওই কবি এই ষোলো নম্বর কবিতার নিচে লিখে দেন – “Paráfrasis a R. Tagore”! অর্থাৎ, ব্যাপারটা টেগোরের কবিতার paraphrase ।

ওই কবির নাম পাউলো নেরুদা! ১৯৭১-এর নোবেলজয়ী কবি।

এতো সব পড়ে আপনাদের কি মনে হবে আমি কি জানি? আমার কাছে নেরুদা স্বমহিমাতেই আছেন!

থাকবেনও!⁠⁠⁠⁠

1

Facebook Comments