ছৌ নাচের ইতিকথা
নামটা কি? ‘ছ’/’ছো’/ছৌ
‘ছৌ’ নাচের নামকরণ নিয়ে অনেক মত প্রচলিত আছে। ড.পশুপতিপ্রসাদ মাহাতো এবং সুধীর করনের মতে,এই নাচের নাম ‘ছো’; আবার বিভূতিভূষণ দাশগুপ্ত ও ড.বঙ্কিমচন্দ্র মাহাতোর মতে এই নাচের নাম ‘ছ’। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড.আশুতোষ ভট্টাচার্য সর্বপ্রথম ‘ছ’ বা ‘ছো’ এর পরিবর্তে ‘ছৌ’ নামটি ব্যবহার করেন এবং বিদেশে এই নাচের প্রদর্শনের ব্যবস্থা করার পরে এই নাচ ‘ছৌ’ নাচ নামে জনপ্রিয় হয়।
‘ছৌ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত দিকটিও বহু আলোচিত। কেউ বলেন ‘ছায়া’ শব্দটি থেকে ‘ছৌ’ শব্দটি এসেছে। কেউ মনে করেন ‘ছম’ শব্দ থেকে ‘ছৌ’ শব্দটি এসেছে।পুরুলিয়া ও ময়ূরভঞ্জের মুন্ডা শব্দমালার ‘ছক’ বা ‘ছট’ শব্দ থেকে ‘ছৌ’ শব্দের উৎপত্তি বলে অনেকে মনে করেন। মুন্ডা ছক শব্দের অর্থ ভূত এবং ছট শব্দের অর্থ অধিকার।শিবপূজার সঙ্গে যেমন ভূতপ্রেত ইত্যাদির সম্পর্ককে হিন্দুধর্মে স্বীকার করা হয়েছে তেমনি শিবপূজারই একটি আনুষ্ঠানিক দিক ‘ছৌ’ নাচ।তাই এই দুইয়ের মিল খুঁজতে গিয়ে ‘ছৌ’ শব্দের সঙ্গে ‘ছক’ বা ‘ছট’ শব্দের সম্পর্ককে একেবারে অস্বীকার করা যায় না।এছাড়াও ড.সুধীর করনের মতে ওড়িয়া ‘ছও'(ছলনা) শব্দটি সীমান্ত বাংলায় ‘ছো’ রুপে উচ্চারিত হয় যার অর্থ সং।আবার,অধ্যাপক সুনীল কোঠারির মতে সংস্কৃত ‘ছায়া নৃত্য’ লোকমুখে ‘ছৌ নাচ’ এ পরিণত হয়েছে।
জন্ম কোথায়? পশ্চিমবঙ্গ,ঝাড়খন্ড না উড়িষ্যা?
ছৌ এর নামকরন নিয়ে যেমন মতভেদ রয়েছে তেমনি এর জন্মস্থান নিয়েও নানা মুনির নানা মত। ছৌনাচ ঝাড়খন্ডের ধানবাদ জেলা,রাঁচি জেলার পাঁচ পরগনা এবং সিংভূম জেলার ধলভূম এবং সরাইকেলা মহকুমায় যেমন প্রচলিত আছে, তেমনি উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ,কেঁওনঝড় অঞ্চলে প্রচলিত আছে,ছৌ নাচের সর্বাধিক প্রচলন পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া জেলায়।তিনটি রাজ্যেই যদি এ নাচের প্রচলন থাকে তবে সংগত দাবিটা কার? উত্তর হলো,কারও না বা তিনটি রাজ্যেরই। প্রাচীন ঝাড়খন্ডের অন্তর্গত ছিলো ছোটোনাগপুর(পুরুলিয়াসহ) মালভূমি এবং উড়িষ্যার ময়ূরভঞ্জ,কেঁওনঝড় আদি স্থানগুলি। ছো নাচের চলনভূমি এ অঞ্চলটিই। এদিক দিয়ে দেখলে ছো নাচ পশ্চিমবঙ্গ,ঝাড়খণ্ড,উড়িষ্যার সম্মিলিত সম্পদ।
‘ছৌ’,তুমি কোথা হইতে আসিয়াছো?
আদিম সমাজে মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন ছিল শিকার। শিকারে যাওয়ার আগে আদিম মানুষ নিজেরাকে উদ্দীপিত করার জন্য নাচতো,তারা বিভিন্ন পশুপাখির গলার স্বর,অঙ্গভঙ্গি নকল করার চেষ্টা করতো। তাছাড়া আদিম সমাজে গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ছিল মানুষের নিত্যসঙ্গী।আদিম মানুষ শত্রুকে আঘাত করার জন্য এবং আত্মরক্ষার জন্য নতুন নতুন কৌশল আবিষ্কারে সচেষ্ট হয় এবং তারফলে জন্ম নিল যুদ্ধের বিভিন্ন পদ্ধতি। পরবর্তীকালে এই কৌশলগুলি তাদের নৃত্যরীতির মধ্যেও প্রবেশ করে। পরবর্তীকালে কৃষিসভ্যতায় মানুষ কিছু জাদুবিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে ফসলের কামনায়,বৃষ্টি আনার জন্য নাচতো।
বাংলা,ঝাড়খন্ড ও উড়িষ্যার যে অঞ্চলগুলিকে ছৌ নাচের জন্মস্থান বলে ধরা হয় সেগুলির প্রকৃতি রুক্ষ,শুষ্ক এবং অনুর্বর। অথচ এই অঞ্চলের বেশিরভাগ মানুষই কৃষিজীবি।তাই বৃষ্টি আনয়নের আদিম বিশ্বাস যে ছৌনাচের পেছনে কাজ করে তা অনস্বীকার্য।
এছাড়া ছৌনাচের বিভিন্ন পালায় শিকারের অনুষঙ্গ অপরিহার্যভাবে ঘুরে ফিরে আসে। শিকারিজীবি মানুষ এবং শিকারের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলি ছৌ নাচের বিভিন্ন পালায় তুলে ধরা হয়। পুরুলিয়ার বিখ্যাত ছৌ শিল্পী পদ্মশ্রী গম্ভীর সিং মুড়া বলেছিলেন যে তিনি জঙ্গলে বিভিন্ন পশুপাখির অঙ্গভঙ্গি,শিকার ধরার কৌশল দেখে তার থেকে তৈরী করেছেন ছৌ নাচের চাল।
পুরুলিয়ার ‘মহিষাসুর বধ’,’তাড়কাসুর বধ’,’মহীরাবন বধ’,’রাবন বধ’ প্রভৃতি পালাতে যুদ্ধের প্রসঙ্গ প্রধান হয়ে ওঠে।শুধুমাত্র কাহিনীতেই নয়,নাচের আঙ্গিকেও যুদ্ধের বিভিন্ন পদ্ধতিগুলি স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়।সরাইকেলা এবং ময়ূরভঞ্জের ছৌনাচের রীতিতেও যুদ্ধশৈলীর প্রভাব স্পষ্ট।
পুরুলিয়া,সরাইকেলা এবং ময়ূরভঞ্জের ছৌনাচের ত্রিধারার উদ্ভব সম্পর্কে রাম রেহমান বলেছেনঃ”All three styles probably have a common origin in the martial arts tradition of the area and are influenced by the rich tribal culture”.
ছৌ অঞ্চলে ভূমিজ,মুন্ডা,কুড়মি,হো,সাঁওতাল,ওরাওঁ,ডোম ইত্যাদি আদিবাসী উপজাতিগুলি সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং এরাই ছৌ নাচের মূল ধারক এবং বাহক। ছৌ নাচের ছন্দে এবং গানবাজনার মধ্যে এই উপজাতিগুলির প্রভাব সুস্পষ্ট।বিবর্তনের পরবর্তী পর্যায়ে ছৌ নাচ তার আদিবাসী প্রকৃতির সঙ্গে অনেক লৌকিক উপাদানের সংমিশ্রণ ঘটিয়েছে।ছৌনাচের বিষয়বস্তুর মধ্যে যেমন রয়েছে মহাভারত,রামায়ণ প্রভৃতির উপাখ্যান,তেমনি রয়েছে লৌকিক বিষয় এবং লোকগাথা।একদিকে এই নাচ যেমন আনুষ্ঠানিক,অন্যদিকে তেমনি লৌকিক।ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ত্রিতাল,কাহারবা,দাদরা,একতাল প্রভৃতির ব্যবহার চোখে পড়ে।রাজা প্রতাপচন্দ্র ভঞ্জদেও ছৌনাচকে শাস্ত্রীয় নৃত্যের পর্যায়ে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাঁরই আমলে ছৌনাচের অনেকগুলি পালায় হিন্দুস্তানি রাগরাগিণী ভিত্তিক সুরের প্রয়োগ ঘটে।পুরুলিয়ার ছৌনাচে শাস্ত্রীয় নৃত্যের বৈশিষ্ট খুঁজতে প্রয়াসী কপিলা বাৎসায়ন বলেছেনঃ
“The Natyasastra devotes a complete chapter to the representation of animals and birds on the stage through masks and skins in the lokdharmi traditions. What we see today in Purulia is perhaps the continuity of the tradition mentioned by Bharata”.
ছৌনাচ বিবর্তনের বিভিন্নস্তরের মধ্য দিয়ে আদিম থেকে লোক লোকনৃত্যের পথ ধরে,নানা শাস্ত্রীয় নৃত্যের প্রভাব গ্রহন করে নিজের গতি এবং জনপ্রিয়তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে।যুগের পরিবর্তন,রুচির পরিবর্তন সত্ত্বেও এই আদিম নৃত্য একটি শক্তিশালী নৃত্যরীতি হিসেবে নিজের আবেদনকে অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছে এখানেই ছৌনাচের অভিনবত্ব এবং অনন্যতা।
তথ্যসূত্রঃ
১)’ছৌ'”: ইন্দ্রানী দত্ত শতপথী
২)’বাংলার লোকনৃত্য’ : শ্রী আশুতোষ ভট্টাচার্য
৩)’বাংলার ছৌনাচ ও গম্ভীর সিং’ : নন্দদুলাল ভট্

ফটোগ্রাফ : সৌমাল্য ঘোষ (flickr)
Facebook Comments