ফরিদা, নন্দা ও সন্তরণবিলাস

burkini

আরে ভাই নন্দা, ভালো আছিস তো? এইভাবে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি।
-আরে ফরিদা আপা, তুমি! সমুদ্রস্নানে! চোখে ভুল দেখছি না তো!
-আমার কথা পরে। আগে তুই বল কবে ফিরলি? কেমন হল ডেটিং?
-এই তো দু’হপ্তা হল এলাম।
-একটু ঝরেছিস নাকি? বেশ দেখাচ্ছে।
-ওই আরকি। পোর্ট পোলো-তে উইকেন্ড কাটিয়ে এলাম।
-নতুন বয়ফ্রেন্ড? নাকি সেই ফরাসি পেইন্টার?
-সেই-ই। আচ্ছা কী ভাবো বলো তো? বিকিনি পরে সমুদ্রে ঘুরে বেড়াই বলে রোজ বয়ফ্রেন্ডও বদলাব???
-আহা চটিস কেন? দ্যাখ তোদের লাইফস্টাইল কত আলাদা। স্বাধীনচেতা মেয়ে তোরা। আমাদের তো আদ্ধেক জীবন বাচ্চা মানুষ করতেই কেটে গেল।
-সে তো তোমাদের চয়েজ।
-চয়েজ? না রে ভাই নন্দা। সবার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এক নয়। দেশে থাকতে কখনও সমুদ্রে নামার অনুমতি পাইনি। কক্সবাজারে বেড়াতে গিয়ে বালিয়াড়িতে দাঁড়িয়ে কত মানুষের উচ্ছ্বাস দেখতাম। ভাবতাম, আমারও যদি এমন জীবন হত। যা হোক, তোদের দেশে এসে দুধের স্বাদ ঘোলে তো মিটল।
-তবে আর কী! নাচো! আর আমার দেশ তোমার দেশের ঠিক পাশেই। ওটা জন্মস্থান। এটা কর্মস্থান।
-আচ্ছা আচ্ছা। তা আজ এমন খিটখিট করছিস কেন বল দেখি!
-মাসিক হয়েছে।
-হায় আল্লা! এই নিয়ে সমুদ্রে!!!
-কেন কাপ তো পরাই আছে।
-এ সময় সাঁতার কাটলে শরীরে ক্ষতি হয় তো! আর শুনেছি রক্তের গন্ধে নাকি হাঙর আসে।
-আপা দেশে গিয়ে কী তোমার বোধবুদ্ধি একেবারে লোপ পেল?
-বয়সে দশ বছরের বড়, পাঁচটা পিচ্চির মা, যা জানি তাই বললাম সতর্ক করতে। নেয়া না-নেয়া তোদের ব্যাপার। আর শোন, তোর গায়ে মোটেই আর বাংলার জল নেই। ম্লেচ্ছ দেশে ঘুরে ঘুরে আচার-বিচার সব খুইয়েছিস।
-যাক গে। এখন বলো তো আচমকা তুমি এই সমুদ্রে কী করে?
-তার আগে তুই বল আমাকে দেখাচ্ছে কেমন?
-এক্কেবারে লেডি ব্যাটম্যান, থুড়ি থুড়ি ব্যাটউওম্যান।
-দেখা দিয়ে কী যায় আসে। কাজের তো। অনলাইনে সস্তায় কিনে দিল তোর দুলাভাই। মানুষটার দিল ভালো রে। সেই যে নিকাহর রাতে বলেছিলাম একদিন সাগরে যাব, এত বছর পরেও মনে রেখেছে ঠিক!
-এই কিম্ভুত পোশাকটা পরে এত মানুষের সামনে সমুদ্রে নামতে তোমার অস্বস্তি হচ্ছে না?
-এই এত মানুষের সামনে খালি গায়ে তোর অস্বস্তি হচ্ছে কি?
-আমি কিন্তু তোমাকে আরেকটু র‍্যাশানাল ভেবেছিলাম।
-এর মধ্যে র‍্যাশানালিটির কী দেখলি নন্দা?
-দ্যাখো, বিকিনি পরা একটা মুক্তচেতনার বিষয়। সারা পৃথিবী জুড়ে মেয়েরা অপ্রেসড। তার ওপর তোমরা পোশাকের নামে আরোই অপ্রেশানে ইন্ধন জোগাচ্ছ!
-আমরা???
-নয়তো কী! কিনছ মানেই সমর্থন করছ।
-যেখানে সাঁতার কাটাটাই একটা মুক্তচিন্তা, সেখানে পোশাকের ধরণ নিয়ে কথা বলা বিলাসিতা মাত্র।
-যে পৃথিবীতে কল্পনা চাওলাও ট্যাম্পন পরে মহাকাশে যাচ্ছে, সেখানে তোমরা গাড়ি চালানোর অনুমতির জন্য হেদিয়ে মরছ।
-মরছি। তার কারণ, পৃথিবী বলতে তুই যে বৃহৎ গোলক বুঝিস, সেটা আসলে গোলকধাঁধা। এক পৃথিবীর মধ্যে অনেক ছোট্ট ছোট্ট পৃথিবী।
-হ্যাঁ আপা, কল্পনা চাওলার পৃথিবী আর তোমার কল্পনার পৃথিবীতে বিস্তর ফারাক। তোমার কোনো ধারণা আছে এইসব বিতর্কের সুযোগ নিয়ে আহিদা জ্যানেত্তি কত মুনাফা লুটছে?
-সে আবার কোন হালার বেটি?
-ওই দ্যাখো। তুমি এটাও জানো না। অথচ বুরকিনি-র মতো একটা স্টুপিড  অ্যাটায়ার নিয়ে সমানে তর্ক করে যাচ্ছ। আহিদা এই কোম্পানির মালকিন, যিনি তোমাদের মতো মুরগি ধরে ধরে জবাই করছেন আর ধর্মীয় কুসংস্কারে ধুনোর গন্ধ ছড়িয়ে নিজের স্বার্থসিদ্ধি করছেন।
-তা তোদের বিকিনি কোম্পানিগুলো কি মাল ফ্রি-তে বেচে নাকি?
-দুটো এক হল না। পণ্য আর পণ্যায়ন পুরোপুরি আলাদা। বাজারে তো কেনাবেচা থাকবেই। নাহলে অর্থনীতি ধসে পড়বে।
-কোনটা পণ্যায়ন সেটা কে ঠিক করবে রে? তোদের বিকিনি কোম্পানি? নাকি প্যারিসের দুনিয়া কাঁপানো র‍্যাম্প শোয়ের অরগানাইজার? আধন্যাংটা হয়ে হাঁটলেই বুঝি খুব আধুনিকতা দেখানো হল?
-বিষয়টা ব্যক্তিস্বাধীনতার। আমি কী চাইছি- তার পক্ষে, এবং সমাজ কী চাপিয়ে দিচ্ছে তার বিরুদ্ধে লড়াই।
-ঠিক। হাজারবার ঠিক। কিন্তু যদি বলি, তুই যে বিকিনিকে তোর মুক্তচিন্তার প্রতিফলন হিসাবে ধরে নিচ্ছিস সেটাও আসলে বড় পৃথিবীর মধ্যেকার কোনো একটা ছোট পৃথিবীর, যেটায় তুই থাকিস, তার চাপিয়ে দেওয়া অভ্যাস?
-ভুল ভুল ভুল আপা। তোমাকে দুলাভাই… আচ্ছা ছেড়ে দাও… তোমাকে তোমার ধর্ম জলে নামার অনুমতিও দিচ্ছে, আবার তার পিছনে ঝুলিয়ে রাখছে একটা শর্ত। সেই শর্তের নির্মাণ হচ্ছে ধর্মের নিরিখে। এটা অপ্রেশন নয়?
-ধর্ম তো একটা সংস্কৃতি। একটা দিনযাপনের অভ্যাস।
-কিন্তু সংস্কৃতির নামে তো তোমার গোষ্ঠী অপসংস্কৃতির দুন্দুভি বাজাচ্ছে রোজ।
-আর তোর সাংস্কৃতিক শিক্ষা কী শেখাচ্ছে দেশের পুলিশ প্রশাসনকে? না, নাইস-বিচের মত পাব্লিক স্পেসে একটা বয়স্ক মহিলার বুরকিনি খুলিয়ে নিজেদের আধুনিকতা জাহির করতে হয়! কেয়া বাত!
-ধর্মীয় অপসংস্কৃতিকে চাগিয়ে তুলতে পারে এরকম যেকোনো কিছুর বিরুদ্ধে ড্রাস্টিক স্টেপ নেওয়াই উচিৎ।
-অপসংস্কৃতিই বা কে ঠিক করল? সেদিন ম্যাগাজিনে পড়লাম বুরখা ব্যান হওয়ার পরেও এদেশে কত মুসলিম মেয়ে বুরখা পরেছে এবং ‘রিপিট অফেন্ডার’ হিসাবে ফাইন দিয়েছে।
-ধুর সালা, তুমি রোববারের দুপুরের চানটাই চটকে দিলে।
-ওরে ও নন্দা ওমন রাগ করে চলে যাস না। পোর্ট পোলো–র গল্পটুকু অন্তত বলে যা!
-ব্যাগে বুরকিনি ভরে দুলাভাইরে নিয়ে ঘুরে এসো। নিজেই জেনে যাবে।

***

Facebook Comments