একটি অবান্তর প্রলাপ অথবা আত্মবেক্ষণের গল্প

রাত তিনটে বাজল। থ্রিবি আর ওয়ানসি জেগে আছে এখনও। বারোটা অন্ধকার আর সেমিঅন্ধকার, ওই নাইটল্যাম্পের অন্ধকার যাকে বলে আর কী, কিউব আর কিউবয়েডের মধ্যে দুটো আলোকময়। সব মিলিয়ে চোদ্দটা চৌখুপি, স্তম্ভাকারে সাজানো, চারটে সারিতে। একটা স্তম্ভ… একটা…! একটা ব্যঙ্গতাচ্ছিল্যময় ব্যাঁকা হাসি খেলে যায় ভুবন কুঞ্জের মুখে।

হ্যাঁ, ভুবন কুঞ্জ। নাম ভুবন, সারনেম কুঞ্জ। কচ্ছপের পিঠের মতো অলস পড়ে থাকা পাকা সড়ক, পাশে ওইরকমই অলস ভঙ্গিতে কিন্তু একটু উপরে পড়ে থাকা বাঁধানো ফুটপাথ, তার পাশে সার দিয়ে দোকানগুলো, আর সেই দোকানগুলোরই মাঝখান দিয়ে টুকুস করে সেঁধিয়ে যাওয়া একটা অকিঞ্চিৎকর গলি। আগে কাঁচা ছিল। আগে মানে ভুবন কুঞ্জের জন্মের সময়। এখন শানবাঁধানো, ঢালাই করা। উন্নয়নদা পৌঁছে গেছেন। তো সেই গলিতে ঢুকে ডানদিকে একটা ফাঁকা জমি ফেলে যে চারতলা বাড়িটা বাইশ বছর ধরে দাঁড়িয়ে আছে তার এমনটাই নাম এবং পদবী। থুড়ি… থুড়ি… স্রেফ বাড়ি নয়… প্রেফিক্স আছে, ফ্ল্যাট। আর সেই ফ্ল্যাটবাড়ির রঙচটা দেওয়ালের গায়ে রীতিমতো স্টীলের পাত কেটে কেটে বসানো এই ‘ভুবন’ স্পেস ‘কুঞ্জ’ হরফগুলো। আর রঙ তো এখন চটেছে। যখন এই নামখোদাই হয়েছিল তখন দিব্যি রঙ ছিল। আকাশী নীলের ওপর লালের বর্ডার। জানালার সানশেডে, মাঝের আর দুইধারের কলামে। দীপু চন্দের পছন্দ ছিল মানতে হবে!

আবার! এই নিয়ে তিনবার হল! থ্রিবি। রঞ্জন লাহিড়ী। সেই হাসিটা আবার দেখা গেল ভুবন কুঞ্জের মুখে। আচ্ছা, রোসো… রঞ্জনের কথা পরে বলছি।

দীপু চন্দকে নিশ্চয়ই বোঝা গেছে? আরে এই ভুবন কুঞ্জের জনক। প্রোমোটার, মশাই প্রোমোটার। এখন তো বেশ শাঁসালো মাল। বড় বড় কাজ করছে। কমপ্লেক্স, টাউনশিপ, রাজনীতি। আর বড় বড় লোকদের সাধারণত অনেক গুণ একসাথে থাকে। এই দীপু চন্দর যেমন— যেমন সৌন্দর্যবোধ, তেমন বাংলাজ্ঞান। এই যে কী সুন্দর স্পেসটা, ভুবন আর কুঞ্জের মাঝে, বাংলায় তুখোড় দখল না থাকলে পারা যায়! অতএব, যাহা হইতে পারিত ভুবনগৃহ কি ভুবনাবাস, বা নিদেনপক্ষে ভুবনের গৃহ, সে সবই ওই মহার্ঘ স্পেসটুকুর মধ্যে দিয়ে বেবাক গলে নিছকই নেম অ্যাণ্ড সারনেম হইয়া গেল।

এঃ… ইল্লি আর কী! ভুবনের গৃহ! তাহা হইলে জীবন, পবনেরা থাকিবে কোথায়? দীপু চন্দ বুদ্ধিমান। স্বাভাবিক। বড়মানুষ যে! সে এখানে ঢোকাবে চোদ্দটা ফ্যামিলি, আর বাড়ির নাম দেখে মনে হবে, সেটা কেবল একজনের? কেন? বাকিরা কি বানের জলে ভেসে এসেছে? তাদের টাকাগুলো কি দীপু চন্দ থুথু দিয়ে গুণে নেয়নি? হ্যাঁ, সবকিছুরই দুটো দুটো মানে থাকে, বুঝতে হয়, অমন একবগগা হলে চলে না!

এই যে এখন রাত তিনটে বাজে। দেখে মনে হচ্ছে না শহরটা ঘুমোচ্ছে? রাস্তার নিয়নগুলোর তীব্রতা কমে ঘোলাটে হয়ে রয়েছে। গাড়ির অবিচ্ছিন্ন শব্দ, চলনবাদন মিলিয়ে, এখন আর নেই। যে ধোঁয়াশার স্তরটা একটা আচ্ছাদনের মতো শহরটাকে ঘিরে থাকে, সেও খানিক ফিকে এখন। ফলে আকাশে চাঁদতারারা, যারা নাকি এমনি সময়ে অবহেলায় পড়ে থাকে, তারাও এখন খানিক অস্তিত্ব ঘোষণা করতে চাইছে। কিন্তু কার কাছে? শহরের দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজন থেকে তোদের ছুটি হয়ে গেছে তো অনেকদিনই। হুঁ হুঁ বাবা… প্রয়োজন! বড় অমোঘ এক শব্দ। ইহাই আবিষ্কারের জননী, আবার ইহার জন্যই, বা অভাবেই, মানুষের লেজ খসে গেছে। অমন চাঁদতারারাও কোনওদিন খসে যাবে শহরের আকাশ থেকে।

সে যাক, কথা হচ্ছিল দুটো মানে নিয়ে। এই যে শহর ঘুমোচ্ছে, আদৌ কি ঘুমোচ্ছে? বেশ নিটোল, নিশ্ছিদ্র ঘুম, যাকে নাকি বাংলায় সাউন্ড স্লিপ বলে, সে কী শহরের হয়? নাঃ, হয় না। এই যে অসভ্যের মতো ভ্যাটভ্যাট আওয়াজ করতে করতে রাতের নিস্তব্ধতার মামাসি করতে করতে একটা বাইক এল, দাঁড়াল গলির মুখে, তিন আরোহীর একজন নেমে গেল, কয়েকটা উচ্চকিত হাহাহিহি, দু’একটা কটু অবান্তর শব্দ উড়িয়ে দিল বায়ুমণ্ডলে, তারপর আবার সেই অসহ্য আওয়াজটা তুলে চলে গেল, এসব তো মাঝেমঝেই হচ্ছে। ফূর্তির বাইক, দরকারের গাড়ি, ট্রাক। বাইক থেকে নামা ছেলেটা গলিতেই ঢুকল, আর ভুবন কুঞ্জের তলায় এসে দাঁড়িয়েই একটা সিগারেট ধরাল। ভঙ্গিটা দেখ, অস্থির। বাড়ি ঢোকার আগে শেষ সিগারেট নিশ্চয়ই। একটু আরাম করে জুত করে খা। তা না, সিগারেটে প্রতিটা টান দিচ্ছে ঊর্ধ্বমুখী হয়ে। শরীরের ভরটা সমানে ডান পা-বাঁ পায়ে অদলবদল করছে। বাইকের সিটে কি ছারপোকা ছিল? নাকি হাগা পেয়েছে? ঐ দেখো, দূরের ওই শূণ্যে ভেসে থাকা খোলা জানালাটা দিয়ে আবার আলোর সাথে জগঝম্প কোনও মিউজিকের আওয়াজ আসতে শুরু করল। এরকমই কোনও জানালা দিয়ে মানবিক চিৎকারও ভেসে আসে হঠাত হঠাত রাতের নিস্তব্ধতাকে ব্যঙ্গ করে। সে চিৎকারও দু’রকম। উল্লাসও হতে পারে, বা আর্তনাদ। সবমিলিয়ে, ওই বুঝলে কিনা, যা দেখছ তা নয়। ঘুমন্ত কিন্তু ঘুমন্ত নয়। সবকিছুরই দুটো মানে থাকে।

আসল কথাটা হল শহরের নিটোল ঘুম হয় না, কারণ শহর গতর খাটায় না। না না, পলিটিকালি কারেক্ট থাকতে হবে বাবা! খাটায়, খাটায়, আর তাই ভোঁসভোঁস করে ঘুমায়ও, তা সে ওই বস্তির লোকজন, সে শ্রমিক বা পাঁচমিশেলি যে বস্তিই হোক না কেন। কিন্তু মধ্যবিত্ত মানুষ মাথার কারবার করে। শয়নেস্বপনেজাগরণে। তাই সাউন্ড স্লিপটিপ ভুলে গিয়ে রাতে জেগে বসে থাকে ভূতের মতো। এখন যেমন আছে থ্রিবি আর ওয়ানসি। রঞ্জন লাহিড়ী আর সদানন্দ বিশ্বাস। সাথে ভুবন কুঞ্জ।

রঞ্জন লাহিড়ীকে ভুবন কুঞ্জ পছন্দই করত প্রথমে। এখনও যে অপছন্দ করে তা নয়, বস্তুত পছন্দ-অপছন্দের অনুভূতিটাই আর এই মানুষগুলোর জন্য হয় না। বরং করুণা হয়, মায়া হয়, আর মাঝেমাঝে চোঁয়াঢেকুর মার্কা এক তীব্র বিরক্তি। কী বিচিত্র একদল মানুষ। পায়ের তলায় মাটি নেই, ফলে শিকড় নেই, আর সেই শিকড়ের বোধটুকুও নেই।  উৎপাদনের সাথে কোনও সম্পর্ক নেই, ফলে বাস্তব জ্ঞানও নেই, অথচ ভাবে সব জানে। ভুবন কুঞ্জ বোঝে, অ-সুখের বোধ না থাকা ভালোই, খারাপ নয়, তাতে সেই রাজার অসুখের পাগলটার মতো সুখে থাকা যায় বটে। ও নিজেও সে চেষ্টা করে। ওর রঙ চটে গেছে। শরীরের নানান জায়গায় ঘায়ের মতো চুনকাম উঠে গিয়ে ভেতরের মাংস বেরিয়ে পড়েছে। ঝড়বৃষ্টিতে আজকাল বড় কষ্ট হয়, হাড়ে ঠাণ্ডা লাগার মতো ভেতরের ইঁটের গাঁথনি অবধি জল পৌঁছে যায়, কনকন করতে থাকে। তা ভুবন কুঞ্জ চেষ্টা করে এসব থেকে মন তুলে নিতে। কিন্তু সে অসুখের নাম যদি ক্যান্সার হয়, তখন? তুমি ভাবো না ভাবো, বোঝো না বোঝো, সে তো নিজের কাজ করবেই। সেটাই দেখে ও, কিভাবে রোগ ছড়িয়ে পড়ছে মানুষগুলোর রন্ধ্রে রন্ধ্রে, প্রতিকারহীন, প্রতিরোধহীন। আর যত সেই রোগ রয়ে যাচ্ছে বোধসীমার বাইরে, তত মানুষগুলো সংকটে দীর্ণ হয়ে যাচ্ছে, হয়ে উঠছে অস্থির। ঠিক একটু আগে ওর তলায় এসে দাঁড়ানো ওই ছেলেটার মতো। এদের ওপর মায়া হবে না?

রঞ্জন লাহিড়ীই একমাত্র তার এই ভুবন কুঞ্জ নামটা নিয়ে আপত্তি করেছিল। নামটা নিয়ে, স্পেসটা নিয়েও। লেখক মানুষ, তাই ভুলটা নজরে পড়েছিল ওর। তখন রঞ্জন লাহিড়ীর বৌ ছিল, সুদেষ্ণা, বয়স কম ছিল, নামডাকও হচ্ছিল বেশ। সেই সুবাদেই পুরনো পৈতৃক শরিকি বাড়ি ছেড়ে সুন্দরী বৌ নিয়ে ভুবন কুঞ্জে ফ্ল্যাট বুক করেছিল রঞ্জন। থ্রিবি। এগারোশো স্কোয়ার ফুট। তারপর যখন থাকতে এল, বাড়ির গায়ে এই ভুবন স্পেস কুঞ্জ দেখে আর এই নামকরণের ইতিহাস জেনে বেশ কিছুদিন ধরে পর্যায়ক্রমে দীপু চন্দ এবং নবনির্মিত ফ্ল্যাট কমিটির কাছে ক্যাচালঝামেলাও করেছিল। ও হো… এই নামকরণের ইতিহাস বলতে মনে পড়ল… না না, রঞ্জন একমাত্র নয়। তাহলে তো একটা গল্পই বলতে হয়। সে গল্প অবশ্য ভুবন কুঞ্জের জন্মের আগের কথা। শোনো তবে… এমনিতে রঞ্জনের এই জেহাদের গল্পের তো আর বিশেষ কিছু বাকি নেই। দীপু চন্দের হাতে সেইমুহূর্তেই আরও দুটো জমি এসে পড়াতে, ফ্ল্যাটের কেউকেউ রঞ্জনকে গোপনে উৎসাহ বা উস্কানি দিলেও মিটিঙে অন্যান্য সব গুরুতর সমস্যা সমাধানে বেশি উদ্যোগী হওয়াতে, নতুন জায়গায় প্রথমেই এসব ফালতু ঝামেলায় রঞ্জনের জড়িয়ে পড়াটা সুদেষ্ণার মোটেই মনঃপুত না হওয়াতে এবং রঞ্জনের নিজেরই লেখালেখি এবং সেই সূত্রে সংবর্ধনা নেওয়ার প্রকোপ বেড়ে যাওয়াতে ও প্রতিবাদ বিশ বাঁও জলে ঢুকে পড়তে দেরি করেনি।

ভুবন কুঞ্জ নামটা দেওয়া আসলে ভুবন দাসের। গত বাইশ বছর ধরে ভুবন কুঞ্জ যেখানে দাঁড়িয়ে আছে, সেখানে তার আগে একটা ব্রিটিশ আমলের দোতলা বাড়ি ছিল। আর ছিল সেই বাড়ির এখানসেখান থেকে জন্ম নেওয়া অসংখ্য অশ্বত্থ-পাকুড়, ঘরগুলোর সিলিং থেকে মাঝেমাঝেই খসে পড়া বিভিন্ন সাইজের চাঙড়, আর সেই চাঙড়গুলির পতনস্থল থেকে একটু একটু করে জায়গা পালটিয়ে নেওয়া বিভিন্ন সংসারী জিনিসপাতি। তা সেই বাড়িরই বড় তরফ এই ভুবন দাস। ফোরএ। সাড়ে ছশো স্কোয়ার ফিট। দীপু চন্দের সঙ্গে এগ্রিমেন্টের সময়ে ভুবন দাস শর্তই দিয়েছিল, হবু ফ্ল্যাটবাড়িটা তার নামে নামাঙ্কিত হওয়া চাই। কী কী ভাবে মানুষ নিজের নামটাকে একটু অমরত্ব দিতে চায়! এবং স্বাভাবিকভাবেই ছোট তরফ ভুদেব দাস, ওয়ানএ, সেম স্কোয়ার ফিট, বেঁকে বসল। বাপপিতেমোর বাড়ি, তোরও যতখান হক, আমারও। হঠাত তোর নামখান খালি অক্ষয় হবে… কেন হে? তাও যদি দু’তরফে সদ্ভাব থাকত, একটু নয় বড়দাদা বলে ক্ষমাঘেন্না করে দেওয়া যেত। কিন্তু তা তো নয়। বরং আজ ভাইয়েভাইয়ে, কাল বৌয়েবৌয়ে, পরশু ইয়েতেইয়েতে ঝগড়াকাজিয়া তো নিত্তিদিনের মামলা। অগত্যা দীপু চন্দকে আসরে নামতে হল। প্রোজেক্টটাকে তো ভেস্তে দিতে দেওয়া যায় না। আর ও যখন বুঝল বড়জন বেশি গোঁয়ার, তখন ছোটকেই টার্গেট করে নরমেগরমে ছুঁচোটা গিলিয়ে দিল। এতদুপায়ে ভুবন দাস স্বনামটির একটি যদ্দিনবিল্ডিংস্থায়ী বন্দোবস্ত করিয়া ফেলিল।

ভুবন দাস এখন বাহাত্তর, হাঁপানি। ছেলে বেকার। মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে, যোগাযোগ ক্ষীণ। পুজোর প্রণামী শাড়িটা এখন প্রণামী হোয়্যাটস্যাপ ভায়া প্রণামী এসেমেস। রাতে কাশির দমক উঠলে তেতাল্লিশ বছরের পুরনো বৌও “মরেও না!” বলে স্বগতোক্তি করে ওঠে।

ভূদেব দাস ছিল রঞ্জনের জেহাদে প্রধান গোপন উস্কানিদাতা। তার এখন ঊনসত্তর। বেতোরুগী। অমাবস্যা-পূর্ণিমায় কাকচিল, সেলসম্যান ও চোরেদের ভুবন কুঞ্জের ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেয় না।

আর রঞ্জনের সেই ব্যর্থ প্রতিবাদটার থেকেই শিশুবয়সেই ভুবন কুঞ্জ বুঝে গেছিল ওকে সারাজীবন এই চোদ্দটা ঘনক আর আয়তঘনের এক আপাতদৃশ্য সমষ্টি হয়েই কাটাতে হবে। এই চৌখুপিগুলোর মাঝের স্পেসগুলো ভুবন আর কুঞ্জের মাঝের স্পেসের থেকেও পোক্ত। একটা বাড়ি কথাটা শুনলে তাই ভুবন কুঞ্জের সেই বিদ্রূপমেশানো হাসিটা পায়।

স্কোয়ার ফিটটাও কী হাস্যকর রকমের ভণ্ডামি না? যা মাপার কথা ছিল আয়তনে, কিউবিক ফিটে, সেটা হয়ে গেল ক্ষেত্রফল! শূণ্যের মাটির মাপ! ছোঃ!!

দুটো শব্দ একসাথে হল। দুটো না, তিনটে। ভুবন কুঞ্জের সামনে দাঁড়ানো ছাতিমটার ডালপালার মধ্যে একটা কাঁচের বোতল এসে ঝুপ করে পড়ে আটকে গেল। ভাগ্যিস! ঢালাই গলিতে পড়ে কাঁচ ভাঙার বিকট শব্দটা থেকে অন্তত রেহাই মিলল। কিন্তু ওই গাছের মধ্যে নিজের বাসায় একটা কাক ঘুম ভেঙে এই অসময়ে কা কা করে চেঁচিয়ে উঠল। আর ওদিকে ওয়ানসিতে সদানন্দ বিশ্বাস টুকিটাকি জিনিসপত্রে ঠাসা একটা পুরনো ড্রেসিংটেবিলের পেল্লায় ড্রয়ার মেঝেতে উপুড় করে দিল।

বোতলটা এসেছে রাস্তার ধারের ফোরবি থেকে, জানে ভুবন কুঞ্জ। এও জানে এরপর ওখান থেকে একটা গোঙানির আওয়াজ আসতে থাকবে। প্রতিরাতের মদ্যপান শেষ করে এখন কর্পোরেটবাবু তার যাবতীয় পৌরুষ নিয়ে চড়াও হবে বৌয়ের ওপর। বিরক্তিতে ওদিককার কানটা বন্ধ করে নিল ভুবন কুঞ্জ।

রঞ্জন লাহিড়ী এখন সিগারেট টানছে ভুরু কুঁচকে। সামনে কম্পিউটার স্ক্রিনে একটা ঝকঝকে সাদা ওয়ার্ড ফাইল খোলা। অন্তত চারবার তাতে কিছু অক্ষরমালা সৃষ্টি হয়েছিল। আর চারবারই রঞ্জন তাদের বিদেয় করেছে। প্রতিবারই অক্ষরমালাগুলো কেমন গোঁয়ারের মতো একটা অনিবার্য পরিণতির দিকে চলে যাচ্ছে। মৃত্যু। সুদেষ্ণা চলে গেছে অনেকদিন হল। মিউচুয়াল সেপারেশন। এদিক দিয়ে বিয়াল্লিশের রঞ্জন লাহিড়ীর সাথে সত্তরের কোঠার সদানন্দ বিশ্বাসের বেশ মিল। একটা করুণার হাসি ফুটল ভুবন কুঞ্জের মুখে।

সদানন্দর গল্পটাও তাহলে একটু হোক। ওদিকে গোঙানি শুরু হয়ে গেছে।

সদানন্দ ওয়ানসি, সোয়া পাঁচশো স্কোয়ার ফিট। বয়স হলেও এখনও যথেষ্ট কর্মঠ। স্বপাক খায়। এবার বয়স হওয়ার ফলে অনেকটা জীবন দেখা হয়েছে। ফলে ইতিহাস সদানন্দ ভালোই জানে। জাহাজে কাজ করেছে সারাজীবন। দেশবিদেশ ঘুরেছে। ফলে ভূগোলও জানে। পড়াশোনার সুবাদে অংক, বিজ্ঞান জানে। আর বাঙালি তথা শহুরে তায় মধ্যবিত্ত হওয়ার দৌলতে রাজনীতি, খেলাধুলো ইত্যাদি তো জানেই।

কিন্তু বেচারি সদানন্দ বিশ্বাস নিজের বৌকেই জেনে উঠতে পারেনি।

ঘটনা হল জাহাজী সদানন্দ টাকা কামাত আর বৌকে টাকা পাঠাত একটা জমি কিনে বাড়ি বানানোর জন্য। মুজতবা আলির গল্পে এরপর সেই সব টাকা ভাইয়ের ফুঁকে দেওয়ার কথা হলেও ইন্দুমতী তা করেনি মোটেই। সে জমিটমির ঝামেলায় না গিয়ে এই ভুবন কুঞ্জে একটা ফ্ল্যাট কিনে নিয়েছিল আর সুন্দর করে সেটা নিজের নামে করে নিয়েছিল। বাদবাকি সব টাকাপয়সাও ঢুকিয়ে দিয়েছিল নিজের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে। অতঃপর সদানন্দ ফিরলে তাকে পরিষ্কার বলে দিয়েছিল, এ সবই তার এবং তার বাপের বাড়ির পয়সায় ও সহযোগিতায় করা। সদানন্দ ফ্ল্যাটে থাকতে পারে কেবল, কিন্তু ওইটুকুই। ইন্দুমতী চাইলে যেকোনও সময় তাকে উৎখাত করতে পারে।

সদানন্দ-ইন্দুমতীর একটি ছেলে। বৌ সরকারী চাকুরে। ইন্দু তখন তাদের সংসারেই থাকে।

এখন ইন্দুমতী কেন সদানন্দের ওপর এতটা বিরূপ হল সে খবর ভুবন কুঞ্জ জানে না। আর সে গল্পের জায়গাও এটা নয়।

কপর্দকহীন সদানন্দর প্রথম ভরসা হল তার এক ভাই। তারপর সে টেঁসে যাওয়ার পর তার সেই ছেলের বৌ। তার সেই ছেলেও ততদিনে বৌয়ের পয়সায় মাল খেতে খেতে ফুটে গেছে।

এবার তার ছেলেটা এমন কুলাঙ্গার হওয়ায় সদানন্দর জানার পরিধিটা বেড়ে গেছে। জাহাজ থেকে ফিরে সদানন্দ জেনেছিল ইন্দুমতী ঠগ। কিন্তু ছেলেটা এমন হওয়ায়, এবং কাউকে দেখতে নারলে স্বাভাবিকভাবেই তার চলন বক্র হওয়ায় সদানন্দ নিশ্চিতভাবেই এখন জানে ও ছেলে তার নয়। হতেই পারে না।

রঞ্জনের সমস্যা অস্তিত্বসংকট। সঞ্জীব রায় সেদিনই আওয়াজ দিয়েছে, রঞ্জন লাহিড়ী এখন মৃত্যু লেখে। ওর লেখা থেকে জীবন ছুটি নিয়েছে। পরপর তিনটে লেখা রিজেক্টেড হওয়ার পর রঞ্জনই খানিক লজ্জার মাথা খেয়ে সঞ্জীবকে জিজ্ঞেস করেছিল, কারণটা কী? তাতে এই উত্তর। অথচ এই সঞ্জীব রায়ই একসময় ফোন করে করে পাগল করে দিত। কদ্দুর রঞ্জন? আরে তুমি লেখাটা না দিলে তো কপি ফাইনাল করতে পারছি না?

তাই রঞ্জন আজ একটা অণুগল্প লিখতে বসেছে। সঞ্জীবদের নেক্সট ইস্যু অণুগল্প সংখ্যা। তাতে ও এমন একটা গল্প পাঠাবে, যেটাকে সঞ্জীবদের সবার প্রথমেই ছাপতে হবে। কিন্তু হচ্ছে না!

কম্পিউটার বন্ধ করে দিল রঞ্জন। খাতাপেন নিয়ে বসতে হবে সেই ছোটবেলার মতো। কলমে লিখলে কাটাকুটি করার একটা সুযোগ থাকে। কম্পিউটারে সবই মুছে যায়। রঞ্জন হন্যে হয়ে এই ভোররাতে কলম খুঁজতে শুরু করল। ভুবন কুঞ্জ দেখল সদানন্দও আঁতিপাঁতি করে তখন একটা খুরপি খুঁজছে।

পিঠটা চড়চড় করে উঠল ভুবন কুঞ্জর। ওর দক্ষিণ দেওয়ালটা, যেটা দিয়ে মোটা মোটা জংধরা পাইপগুলো নেমে গেছে, সেই পাইপের ধারের দেওয়ালগুলো সবসময়েই স্যাঁতস্যাঁতে ভিজে ভিজে হয়ে থাকে। সেখান দিয়েই একটা অশ্বত্থ হঠাত শিকড় চারিয়ে দিল ওর একদম মাংস ভেদ করে। লাগে, কিন্তু এই ব্যথার সুখও আছে। প্রাণধারনের বেদনা অনুভূত হয়।

যাক গে, যে কথা হচ্ছিল, সদানন্দর এই জিনিসটা ভুবন কুঞ্জের ভালো লাগে। ভুবন কুঞ্জের পেছনে পশ্চিম পাশটায় যেখানে দীপু চন্দকে বাধ্য হয়ে দশ ফুট ছাড় দিতে হয়েছে, সেখানে একচিলতে ফাঁকা মাটি আছে। সদানন্দর একতলার ঘর লাগোয়া। সদানন্দ অজয়কে মাসে একটা টাকা দিয়ে সেখানে রীতিমতো চাষবাস করায়। অজয়ও ভুবন কুঞ্জের বাসিন্দা। কিন্তু ওর কোনও নম্বর নেই। ও ভুবন কুঞ্জের সিকিওরিটি গার্ড। বিল্ডিংলাগোয়া ওর বরাদ্দ একচিলতে ঘরটায় ও বৌ নিয়ে থাকে। আজ অবশ্য নেই অজয়। দেশে গেছে ধান লাগাতে। আর দেরি করলে বিছন নষ্ট হয়ে যাবে।

ভুবন কুঞ্জের হঠাত মনে পড়ল অজয়ের বৌটা তো এখনতখন পোয়াতি। হ্যাঁ, পাশের বাড়ির সুমিতা আজ শুতে এসেছে বটে ওর সাথে। সুমিতা হাসপাতালে আয়ার কাজ করে।

শীত আসছে। তাই সদানন্দ কালকেই কটা পালং আর মটরশুঁটির বীজ লাগাতে চায়। অজয় আসা অবধি অপেক্ষা করা যায়। কিন্তু সদানন্দ করতে চায় না। ও অজয়ের কাজকর্ম সব দেখে বসে বসে। অতএব, ও চাষ করতে জানে। মধ্যবিত্তরা যেমন সবই জানে পড়ে, দেখে, শুনে, হাতেকলমে না করে!

সদানন্দ প্রমাণ করতে চায় ও উৎপাদনে অক্ষম নয়। নিজের কাছেই বোধহয়।

খুরপিটা এখনও পায়নি সদানন্দ। কলমটাও রঞ্জন। কপালে বিজবিজ করে ঘাম ফুটে উঠছে দুজনেরই এই হালকা হিম আবহাওয়ার মধ্যেও। মুখদুটোকে অসহায়তা গ্রাস করছে। ভুবন কুঞ্জের একটা ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস পড়ল।

এইসময়েই একঝলক নরম হিমেল বাতাসের সাথে একটা বাচ্চার কান্না ভোরের পাখির কিচিরমিচিরের সাথে মিশে ছড়িয়ে পড়ল ভুবন কুঞ্জের সর্বাঙ্গে, আশেপাশে। আঃ… কতদিন পর এ বাড়িতে শিশুর জন্ম!

ভোরের সেই আবছা আলোয় ভুবন কুঞ্জ স্পষ্ট দেখতে পেল নবজাতকের একহাতে ধরা একটা কলম আর একহাতে একটা খুরপি।

Facebook Comments


Tags :