আয়নাতে কার মুখ?

আমার বয়স সাতাশ বছর। মহাখালীতে একটা ইলেক্টনিক্স পণ্যের শোরুমে সেলসম্যান হিসেবে কাজ করতাম আমি। কাজ মানে কাস্টমারকে পটিয়ে মাল গছানো আর কি! এই বিদেশী ইলেক্ট্রনিকস কোম্পানির শোরুমে টিভি, ফ্রিজ, এসি থেকে শুরু করে হেয়ার ড্রায়ার পর্যন্ত সব ধরনের ইলেকট্রনিক্স পন্য পাওয়া যায়। আপনারা কেউ যদি এদিকটায় এসে থাকেন কোন ইলেকট্রনিক্স পন্য কেনার জন্য, কিংবা শুধু দেখেটেখে যাবার জন্য, অদূর ভবিষ্যতে কখনও কিনবেন এই আশায়, তাহলে হয়তো আমার দোকানেও এসে থাকবেন। আমার দোকান, মানে আমি যে দোকানটায় চাকরি করতাম, সেখানে আর কি। আমার সাথে আপনাদের হয়তো কথাও হয়েছে, মানে আমি নিজেই এগিয়ে গিয়ে আপনাদের সাথে কথা বলেছি, হাসিমুখে পণ্যের গুণগান করেছি। তবে আমার কথা আপনাদের নিশ্চয়ই মনে নেই, মনে থাকার কথাও না। দোকানের সেলসম্যানের দিকে কেউ ভালমত তাকায় না, অবশ্য সেলসগার্ল হলে অন্য কথা। তখন অনেকেরই নজর দোকানের মালের চেয়ে সেলসগার্লের দিকেই থাকে বেশি। আমার কলিগ তামান্না, যে কিনা ভালমত কথাও বলতে পারেনা, তারপরও কাস্টমাররা তার কাছেই বেশি যায়। আমি খেয়াল করে দেখেছি চাকরিজীবি মাঝবয়সী মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকেরা, যাদের শার্ট ঠেলে ভুঁড়ি বের হয়ে এসেছে, মাথার চুল সামনের দিক থেকে হালকা হয়ে যেতে শুরু করছে তাদের মাঝেই এই প্রবণতাটা বেশি। সংসারজীবনে অসুখী মাঝবয়সী এই মানুষগুলোর চোখের মাঝে একধরনের অদৃশ্য অতৃপ্তি খেলা করে। এই অতৃপ্তি দূর করার ব্যর্থ চেষ্টা হিসেবে এরা মনের মধ্যে একটা ফ্যান্টাসীর জগৎ তৈরি করে, যে জগত আবর্তিত হয় কোন রূপবতী তরুণীকে কেন্দ্র করে, যার বয়স সাধারণত তাঁর নিজের বয়সের অর্ধেক।

অবশ্য, কে আমাকে মনে রাখল আর কে রাখল না এ নিয়ে আমার কোন মাথাব্যাথা নেই। আমি সিনেমা বা নাটকের কোন উঠতি মডেল নায়ক না যে আমার দিকে কেউ মনযোগ না দিলে মনের মধ্যে খচ করে আলপিনের খোঁচা লাগবে। আমি আসলে এসব নিয়ে ভাবিই না, জীবনকে যাপনের চিন্তা বাদ দিয়ে কেবল মাত্র ধারণের চিন্তাতেই যার ব্যস্ত থাকতে হয়ে তাকে এসব তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ভাবলে চলে না। বেতন নিয়ে সামান্য খচখচানি আছে অবশ্য, বিদেশী কোম্পানীর শোরুম হলেও বেতনের বেলায় কিপ্টেমিতে এরা দেশীরও বাড়া। অবশ্য পড়াশোনার দৌড় আমার ইন্টারমিডিয়েট পর্যন্ত, এই পড়াশোনায় আর কত ভাল বেতনই বা পাব। কপাল ভাল যে আমার দুরসম্পর্কের এক চাচা এই চাকরিটা আমাকে জোগাড় করে দিয়েছে, না হলে আপনজনবিহীন এই শহরে আমাকে না খেয়ে মরতে হত।
তো সব মিলিয়ে ভালই কাটছিল দিনগুলো আমার।

সবকিছুই যখন ভালই চলছিল তখন সমস্যাটা হল কোথায়? হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন। সমস্যাটা তৈরি হল তামান্নাকে কেন্দ্র করেই। একই সাথে দীর্ঘদিন কাজ করতে গেলে যেটা হয় আর কি। প্রথমে চোখাচোখি, তারপর ঠোকাঠুকি, তারপর…।
হ্যাঁ, আমি তামান্নার প্রেমে পড়ে গেলাম। আর কী আশ্চর্য! প্রেমে পড়ল তামান্নাও!
আমি পড়লাম তামান্নার প্রেমে। আর তামান্না পড়ল বদরুল হাসানের প্রেমে।
ওহ হো! বদরুল হাসানের পরিচয়টা দিয়ে নিই।

সেদিন আমার মনটা খুব ভাল ছিল। সন্ধ্যায় এক পশলা বৃষ্টি হয়েছে, দোকানে কোন কাস্টমার নেই, বাইরে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দুচারজন পথচারী মাঝেমধ্যে থেমে দাঁড়িয়ে স্বচ্ছ কাঁচের মধ্য দিয়ে ডিসপ্লেতে চালু করে রাখা আট দশটা টিভিতে চলা অনুষ্ঠান দেখছে। আমি আর তামান্না পাশাপাশি দুটো প্লাস্টিকের টুলে বসে টুকটুক করে গল্প করছিলাম। গল্প আসলে একা তামান্নাই করছিল, আমি চুপচাপ শুনে যাচ্ছিলাম। নতুন প্রেমে পড়া ছোকড়াগুলো যেমন চোখের মধ্যে আলগা মুগ্ধতা নিয়ে তাকিয়ে থাকে প্রেমিকার দিকে, আমিও একই দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম তামান্নার চোখের দিকে। এমন সময় দোকানের স্লাইডিং ডোর ঠেলে ভেতরে ঢুকলো এক যুবক। আমি উঠে দাঁড়ানোর আগেই তামান্না উঠে দাঁড়িয়ে এক ছুটে এগিয়ে গেল নবাগত কাস্টমারকে অ্যাটেন্ড করানোর জন্য। মুখে ঝকঝকে একটা আর্টিফিশিয়াল হাসি ঝুলিয়ে বলল, ‘স্যার, কী করতে পারি আপনার জন্য?’
পাঁচফুট লম্বা তামান্নাকে প্রায় ছফুট লম্বা নবাগত কাস্টমারের সাথে হাত নেড়েনেড়ে কথা বলতে দেখে অকারণেই আমার বুকের মধ্যে একটা ধাক্কার মত লাগল। কিন্তু কিছুই করার নেই আমার।
তামান্নার কাজ তামান্না করছে, কাস্টমার পটাচ্ছে তায়।
তাই বলে কি রাগারাগি করা আমার শোভা পায়?

ওদের উপর রাগটা ঝাড়তে না পেরে সমস্ত রাগটা গিয়ে পড়ল বাইরের ফুটপাতে দাঁড়ানো একমাত্র দর্শকটার উপর। পঞ্চাশের আশেপাশে বয়স হবে লোকটার, ডিসপ্লেতে চলা টেলিভিশনে ফুটবল খেলা দেখছে। চেলসি-ম্যানসেস্টার সিটি ম্যাচ দেখানো হচ্ছে সবগুলো স্ক্রিনেই। কিন্তু আমি জানি ওই মাঝবয়সী টেকো লোকটা ফুটবল খেলা দেখার জন্য দাঁড়িয়ে নেই। সে দাঁড়িয়ে আছে তামান্নাকে দেখার জন্য। লোকটাকে আমি আগেও লক্ষ্য করেছি। টিভির দিকে তাকিয়ে থাকার ভান করে আসলে চোখ কোণা দিয়ে তাকিয়ে থাকে তামান্নার দিকে। বুকের মধ্যে এক ধরনের অবদমিত কামনা নিয়ে বেঁচে থাকা সংসারজীবনে অসুখী মানুষের আরেকটা উদাহরণ। এই লোকের অবদমিত কামনা প্রশমিত করার ফ্যান্টাসী হচ্ছে তামান্না।

আপনারা হয়তো ভ্রু কুঁচকে ভাবছেন ইন্টারমিডিয়েট পাশ করা একজন স্বল্পশিক্ষিত সেলসম্যানের হিউম্যান সাইকোলজি বিষয়ে এত জ্ঞান থাকে কী করে! বলছি। প্রথমত, ইন্টারমিডিয়েট পাশ হলেও আমার বই পড়ার নেশা মারাত্মক। বিশেষ করে মানুষের মনস্তত্ব নিয়ে লেখা গল্প-উপন্যাসগুলো আমার খুবই পছন্দ। মিসির আলীকে নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের সবগুলো লেখা কয়েকবার করে পড়ে ফেলেছি আমি। দ্বিতীয়ত, আমার কাজের সুবাদে প্রতিদিন অসংখ্য ধরনের বিচিত্র সব মানুষের সাথে কথা বলতে হয়। ভাল সেলসম্যান হওয়ার প্রথম শর্ত হিউম্যান সাইকোলজি বিষয়ে ভাল দখল থাকা। তবে ওই মুহুর্তে আমি যে কাজটা করলাম সেটা কোন ভাল সেলসম্যান দূরে থাক, সবচেয়ে খারাপ সেলসম্যানও করবে বলে মনে হয় না।

তামান্নাকে নবাগত সুদর্শন কাস্টমারের সাথে হাসিমুখে কথা বলে যাচ্ছে। আমার কেন যেন মনে হতে লাগল প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই হাসছে ও। মাথার ভেতর যেন কী ঘটে গেল আমার! আর সহ্য করতে পারলাম না। তবে যত যাই হোক কাস্টমারকে তো আর কিছু করা সম্ভব না, কাজেই সমস্ত রাগ ঝাড়ার জন্য বেছে নিলাম ফুটপাতে দাঁড়ানো মাঝবয়সী লোকটাকেই। স্লাইডিং ডোর ঠেলে বের হয়ে গিয়ে প্রায় ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম লোকটাকে।
‘এইখানে কি? যান ভাগেন! আর যদি এইখানে দেখি আপনারে…!’
ধাক্কা খেয়ে লোকটা এমন হতভম্ব হয়ে গেল যে রাগতেও ভুলে গেল। এক মুহুর্তের জন্য মনে হল কিছু বলবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছু না বলেই মাথা নিচু করে হেঁটে চলে গেল। একবারও ফিরে তাকাল না।
ততক্ষনে টনক নড়ল আমার! রাগের মাথায় মারাত্মক ভুল করে ফেলেছি। চাকরি নিয়েই হয়তো টানাটানি পড়ে যাবে এখন। তবে কপালটা ভাল আমার। ভেজা বেড়ালের মত মুখ করে শোরুমে ঢুকে দেখি, তামান্না এবং ম্যানেজার দুজনই ব্যস্ত আছে সেই কাস্টমারের সাথে। আমি হাফ ছেঁড়ে বাঁচলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই কাস্টমার চলে গেল, যাওয়ার আগে জানিয়ে গেল আগামীকাল আবার আসবে পছন্দ করা টিভি সেটটা নেয়ার জন্য।
ততক্ষনে ভদ্রলোকের নাম জেনে গেছি আমি, বদরুল হাসান। একটা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে উঁচুপদে চাকরি করেন।
বদরুল হাসান বিদায় নেয়ার পর ম্যানেজার সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। এবং তখনই আমার ভুল ধারণা ভেঙ্গে গেল যে, তিনি আমার কান্ডটা লক্ষ্য করেন নি। ম্যানেজারদের সবকিছু লক্ষ্য করতে হয়। তিনি আমাকে ভালভাবে শাসিয়ে দিলেন যে ভবিষ্যতে যদি আর কখনও এরকম কিছু দেখেন তাহলে আমার অন্যত্র চাকরি খুঁজতে হবে। মন খারাপ করে বাসায় চলে এলাম।
পরদিন আবার এল গতকালের সেই বদরুল হাসান। তামান্না কেন সেদিন এত সেজেগুজে এসেছে সেটাও বুঝতে সমস্যা হল না। যা হোক ম্যানেজার আর তামান্নার সাথে বেশ কিছুক্ষন কথা বলার পর টিভি নিয়ে বিদায় হলেন। আমি নিজেই টিভিটা বয়ে নিয়ে তাঁর গাড়িতে তুলে দিলাম। ঝা চকচকে নীল রঙের টয়োটা প্রিমিয়ো। তামান্নাও গাড়ির দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এসেছিল, আমি শোরুমে ফেরার পরও দেখতে পেলাম দুজনে গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলছে। সেদিন তামান্না একটু আগেই বের হয়ে গেল। এরপর থেকে প্রায়ই এমন হতে লাগল। একবার তো ছুটি নিল এক সপ্তাহের জন্য।
এভাবেই একদিন শতশত কাস্টমারকে পটানো তামান্না নিজেই পটে গেল আরেকজন কাস্টমারের কাছে। তারপর হঠাৎ একদিন তামান্না চাকরিটা ছেড়ে দিল। হাসিমুখে জানাল বিয়ে করছে ও। পাত্র কে? বদরুল হাসান।

আমার কথা বলি। মন মেজাজ তিরিক্ষি থাকার কারনে কাস্টমারদের সাথে নিয়মিত খারাপ ব্যবহার করতে শুরু করেছিলাম কিছুদিন আগে থেকেই। ম্যানেজার সহ্য করলেন কিছু দিন। তারপর একদিন জানিয়ে দিলেন, আমাকে বরখাস্ত করা হয়েছে। কাজেই এখন রাস্তা মাপতে পারি আমি। আমি কথা না বাড়িয়ে রাস্তা মাপলাম।
এমনিতেই এখান থেকে মন উঠে গেছে আমার। শেষদিকে এসে বুঝতে পেরেছিলাম যে, আমি আসলে এখানে তামান্নার জন্যই আছি। তা না হলে এই অল্প টাকার ছ্যাঁচড়া চাকরি ছেড়ে অন্য কোথাও যাওয়ার কোন চেষ্টা করতাম না কেন!
ওহ… আরেকটা ব্যপার। সেদিনের ধাক্কা কান্ডের পর সেই মাঝবয়সী ভদ্রলোক আর শোরুমের সামনে এসে দাঁড়াননি। তবে রাস্তার উল্টোপাশের চায়ের দোকানে বসে থাকতে দেখেছি মাঝেমধ্যে।
যা হোক, চাকরি চলে যাবার পর আমার আয়ের পথও বন্ধ হয়ে গেল। ব্যাংকে অল্প কিছু যা সঞ্চয় ছিল সবই তুলে ফেললাম। খরচ বাঁচানোর জন্য আমার আগের বাসাটা ছেড়ে দিয়ে নতুন ঠিকানায় উঠে পড়লাম। কলাবাগানের লাজফার্মার পাশের গলিটার অনেকটা ভেতরে একটা শ্যাওলাপরা ছয়তলা বিল্ডিঙের চিলেকোঠা হল আমার নতুন ঠিকানা। চিলেকোঠার মাঝখানে কার্ডবোর্ডের পার্টিশন দিয়ে দুভাগ করা। পার্টিশনের ওপাশে থাকেন আরেকজন ভাড়াটে। ভদ্রলোকের নাম খালেকুর রহমান, কী একটা ছোটখাট ব্যবসা নাকি করেন। ভদ্রলোকের হাবভাব কেন জানি সন্দেহজনক মনে হয় আমার কাছে। কেমন একটা চোরচোর ভাব, মনে হয় কারও কাছ থেকে পালিয়ে আছেন। সারাদিন বাসা থেকে বের হননা। মোড়ের হোটেলের সাথে তার কন্ট্রাক্ট করা আছে, তারাই সকালে আর দুপুরে খাবার পৌছে দিয়ে যায়। রাতের খাবারটা অবশ্য হোটেলে গিয়েই খান। তবে এসব নিয়ে মাথা ঘামাই না আমি। আমি থাকি আমার মত। একটা কেরোসিন স্টোভ আর দুটো হাড়ি-পাতিল কিনে নিয়েছি, নিজেই রান্না করে খাই। সারাদিন রুম থেকে বের হইনা। নতুন কোন চাকরির চেষ্টাও করি না। বিকেলের দিকে ধানমন্ডি পার্কের গিয়ে লেকের ধারে বসে থাকি। অন্ধকার গাঢ় হওয়ার পর ফিরে আসি। মাঝে মধ্যে আমার পুরানো কর্মস্থল সেই শোরুমের উল্টোদিকের চায়ের দোকানে গিয়ে বসে থাকি। আশা যে সেই ভদ্রলোকের সাথে দেখা হয়ে গেলে মাফ চেয়ে নেব।
এভাবেই কেটে যাচ্ছিল আমার দিনগুলো। তারপর হঠাৎ একদিন টের পেলাম আমার মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। পুরোপুরি খারাপ হয়নি, শুরু হয়েছে মাত্র। পুরোপুরি মাথা খারাপ হলে নিজেও বুঝতে পারতাম না যে মাথা খারাপ হয়ে যাচ্ছে!

ঘটনাটা বলি।
প্রতিদিনের মত সন্ধ্যার পর ধানমন্ডি লেক থেকে ফিরে এসে রুমের তালা খুলেই একটা ধাক্কা খেলাম। না, কোন কিছুর সাথে ছোঁয়া লেগে ধাক্কা খাইনি, মানসিক ধাক্কা। ওপাশের বিল্ডিং থেকে আসা এক ফালি আলো এসে পড়েছে আমার বিছানায়, সেই আবছা আলোয় দেখতে পেলাম একটা লোক বসে আছে বিছানার উপর। রুমের দরজায় বাইরে থেকে তালা মারা ছিল, কাজেই ভেতরে লোক থাকার কারণ নেই। দ্রুতই ধাক্কাটা সামলে নিলাম। ঘরে আবছা অন্ধকার, কাজেই অবশ্যই চোখের ভুল হচ্ছে আমার। দ্রুত সুইচ টিপে বাতি জ্বালিয়ে দিলাম। এনার্জিসেভারের উজ্জ্বল আলোয় ভরে গেল আমার ছোট্ট রুমটা। নাহ! কোন অপরিচিত লোক আমার খাটের উপর বসে নেই। খাটের উপর বসে আছে আমার অতি পরচিত একজন। তামান্না!
আমি হতভম্ব অবস্থা কাটিয়ে ওঠার আগেই কথা বলে উঠল সে। খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলল, ‘এতক্ষন ধরে কেউ বাইরে থাকে? সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি!’
আমি কোন কথা না বলে চোখ বন্ধ করে উল্টো দিকে গণা শুরু করলাম। ‘একশো, নিরানব্বই, আটানব্বই, সাতানব্বই, ছিয়ানব্বই, পঁচানব্বই…’’’’’। আমি জানি, যা দেখছি পুরোপুরি চোখের ভুল। বইয়ে পড়েছি এরকম ঘটনার কথা। মিসির আলী সাহব এ ধরনের ঘটনার চমৎকার ব্যাখা দিয়েছেন। তামান্নাকে পাবার জন্য প্রতি আমার মনে তীব্র আকাঙ্খার সৃষ্টি হয়েছে, আর সেই আকাঙ্ক্ষা পুরণ করতে আমার মস্তিষ্ক তৈরি করেছে কাল্পনিক তামান্নাকে। সহজ ব্যাখ্যা। সাইকোলজির ভাষায় একে বলে হ্যালুসিনেশন। ভিজ্যুয়াল এবং অডিটরি হ্যালুসিনেশন।
একশো থেকে এক পর্যন্ত গোণা হয়ে গেলে চোখ খুললাম আমি। যা ভেবেছিলাম তাই। ফাঁকা খাট, কেউ নেই রুমের ভেতর। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমি।
‘কি করেন ভাইজান?’ হঠাৎ পেছন থেকে কেউ কথা বলে ওঠায় চমকে উঠলাম। দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে ওপাশের ভাড়াটে খালেক সাহেব। আমার চোখ বন্ধ করে কাউন্টডাউন করা দেখে ফেলেছেন নিশ্চয়ই। আমাকে পাগল ভাবছেন কোন সন্দেহ নেই।
‘কিছু করছিলাম না। আচ্ছা খালেক সাহেব, আপনি কি এইমাত্র একটা মেয়েকে বের হয়ে যেতে দেখেছেন?’ উচিত হচ্ছে না জেনেও প্রশ্নটা করা করলাম।
খালেক সাহেব একটা ঢোক গিললেন।
‘মেয়ে? বয়স কেমন?’
‘তরুণী। বিশ বাইশ বছর হবে। দেখেছেন?’
‘দেখতে কেমন?’
‘দেখতে কেমন সেটা তো বিষয় না। আপনি কোন মেয়েকে বের হয়ে যেতে দেখেছেন কি না?’
‘না। দেখি নাই। মেয়েটা কোথা থেকে আসছিল? কাউকে খুঁজতেছিল?’
আমি উত্তর দিলাম না। আমার সন্দেহ বদ্ধমুল হল যে খালেক সাহেব কারও কাছ থেকে পালিয়ে আছেন। হয়তো কোনও তরুণীর কাছ থেকে!
আর কিছু না বলে নিজের রুমে চলে গেলেন তিনি। দরজা লাগানোর আওয়াজ পেলাম।
যাহোক, তামান্না সেদিনের মত বিদায় হলেও দু’দিন যেতে না যেতেই আবার উদয় হল। প্রায় প্রথমবারের মতই ঘটনা। সন্ধ্যার পর দরজা খুলে দেখি আগের মত করেই খাটের উপরে বসে আছে। তবে প্রথমবারের মত এত সহজে বিদায় করা গেল না এবার। এরপর থেকে প্রায় নিয়মিতভাবেই তামান্নার আগমন ঘটতে লাগল। আমি পাত্তা দেই না, কারণ আমি জানি যা দেখছি পুরোটাই আমার কল্পনা। সে থাকে তার মতো, আমি থাকি আমার মতো। কিন্তু সে যখন আমার রুমের স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে গেল, আমার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে শুরু করল, আমি বাথরুমে গেলে নক করা শুরু করল, তখন আর আমার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হল না। এক রাতে রেগেমেগে চিৎকার করে রীতিমত ঝগড়া শুরু করে দিলাম। তামান্না বিছানার এক কোনে বসে মাথা নিচু করে কাঁদতে শুরু করল। আমার চেঁচামেচি শুনে ওপাশ থেকে খালেক সাহেব ছুটে আসলেন।
‘কী বিষয় ভাই? কার সাথে ঝগড়া করেন? কার সাথে কথা কন?’
‘দেখতে পাচ্ছেন না! আমি খাটে বসা তামান্নার দিকে আঙুল তাক করলাম। ওর সাথে!’
খালেক সাহেব এমনভাবে আমার দিকে তাকালেন যেন পাগলাগারদ থেকে পালিয়ে আসা পাওয়া পাগল দেখছেন। দ্বিতীয় কোন কথা না বলে প্রায় দৌড়ে নিজের রুমে চলে গেলেন তিনি, ঠকাস করে দরজা আটকানোর আওয়াজ পেলাম।
খালেক সাহেব চলে যেতেই মাথা ঠান্ডা হয়ে এল। বুঝলাম পাগল হওয়ার পথে অনেকটা এগিয়ে গেছি। সম্ভবত দ্বিতীয় বা তৃতীয় ধাপে আছি।
আমি টের পাই রাস্তার লোকজন অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে। চুল দাঁড়ি কাঁটা বাদ দিয়েছি অনেক দিন হল। মাথায় মুখে চুল দাড়ির জঙ্গল হয়ে গেছে। আয়নার দিকে তাকালে নিজেই হয়তো আর নিজেকে চিনতে পারব না!
আমি বুঝতে পারছিলাম আমার মাথা খারাপ দ্রুত বাড়ছে। দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা না করলে পুরোপুরি খারাপ হয়ে যেতে সময় লাগবে না।
কাজেই আমি মানসিক রোগের ডাক্তার খুঁজতে বের হলাম। কাজটা আমার জন্য সহজ হলনা। অনেকদিন হল এই শহরে থাকলেও, শহরটা আমার কাছে অপরিচিতই রয়ে গেছে। তাছাড়া আমার কোন বন্ধুবান্ধবও নেই যে সাহায্যের জন্য যাব। আর আমার পক্ষে মোটা অংকের ভিসিট দেয়াও সম্ভব হবে না।
তবে অনুসন্ধানের ফল একেবারে বৃথা গেল না। হঠাৎ একদিন ভাগ্য খুলল আমার। সন্ধ্যার দিকে ধানমন্ডি লেকের এক কোণায় কয়েকজন বয়স্ক লোক আড্ডা দিতে বসেন। এঁদের প্রায় সবাই সফল কর্মজীবন থেকে অবসর প্রাপ্ত ভদ্রলোক। দেশ-বিদেশ, অর্থনীতি, রাজনীতি সব বিষয়ে কথা বলেন তাঁরা। আমি একটু দূরে বসে তাঁদের কথাবার্তা শুনি। ভালই লাগে আমার। একদিন এঁদের আড্ডায় আড্ডায় জ্বিন-ভুতের কথা উঠলো! সেদিন এঁদের সবার কথাবার্তা শুনে আবিস্কার করলাম, থুতনিতে এক গোছা কাঁচাপাকা দাড়িওয়ালা, মাথায় টুপি পড়া স্বল্পভাষী বৃদ্ধলোকটা, যিনি প্রতিটা ভৌতিক ঘটনার ব্যাখ্যা দেয়ার চেষ্টা করছেন, তিনি আসলে একজন রিটায়ার্ড সাইকিয়াট্রিস্ট। আমি ঠিক এরকম কাউকেই খুঁজছিলাম! সেদিন থেকেই ভদ্রলোকের সাথে কথা বলার সুযোগ খুঁজতে লাগলাম। দ্রুতই সুযোগটা চলে এল। একদিন অন্য সবাই চলে গেলেও ভদ্রলোক একাএকা বসে রইলেন। আরও কিছুক্ষন সম্ভবত কাঁটাতে চান পার্কে। দেরি না করে সাহস করে এগিয়ে গেলাম ভদ্রলোকের কাছে। আমি কিছু বলার আগেই ভদ্রলোক বলে উঠলেন,
‘আপনাকে কিছুদিন ধরেই লক্ষ্য করছি। আপনি মনে হয় আপনি আমাকে কিছু বলতে চান।’
আমি একটা ঢোক গিললাম! নিশ্চিত হলাম যে, ঠিক লোকের কাছেই এসেছি। কাজেই কোন ভনিতা না করে নিজের পরিচয় দিয়ে খুলে বললাম আমার সমস্যার কথা। গম্ভীর মুখে চুপচাপ সব শুনে গেলেন তিনি, একটা কথাও বললেন না। আমার মনে হল ভদ্রলোক বিরক্ত হননি, বরং খুশিই হয়েছেন। অনেকদিন পর নিজের সাবজেক্টে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন বলেই হয়তো! প্রায় মিনিট দশেক চুপচাপ থাকার পর মুখ খুললেন তিনি,
‘সব কথা শুনে মনে হচ্ছে আপনার নিজেরই মোটামুটি পড়াশোনা আছে মানসিক রোগ সম্পর্কে।’
কথাটা একেবারে ভুল না, কাজেই মাথা ঝাঁকালাম আমি।
‘আপনার নিজের ধারণা কি? কি সমস্যা হয়েছে আপনার?’
‘হ্যালুসিনেশন। ভিজুয়াল এবং অডিটরি হ্যালুসিনেশন।’
‘শুধুই কি হ্যালুসিনেশন?’ অদ্ভুত শীতল কণ্ঠে বলেন ভদ্রলোক, গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।
‘জানি না আমি।’ দুর্বল গলায় বললাম আমি।
‘মানসিক রোগের চিকিৎসার সবচেয়ে বড় মজা হলো, রোগী যদি বুঝতে পারে যে সে অসুস্থ, তাহলে আপনাআপনি রোগ অর্ধেক ভাল হয়ে যায়। আপনি তো রোগটাই ধরে ফেলেছেন। আপনার ঠিক হচ্ছে না কেন?’
‘আমি জানি না! জানার জন্যই আপনার কাছে এসেছি।’
‘আমার মনে হয় আপনি জানেন। আপনার অবচেতন মন জানে। কিন্তু আপনার সচেতন মন ব্যাপারটা জানতে চায় না। বা জানলেও মানতে চায় না।’
আমি কিছুই বললাম না। টের পেলাম, এই শীতের মধ্যেও দরদর করে ঘামছি আমি!
‘আমার মনে হয় আপাতত কিছুই করার নেই আমার। আপনার সমস্যার সমাধান আপনারই হাতে। আর যে কোন সমস্যা সমাধান করতে চাইলে, সবার আগে সমস্যাটাকে স্বীকার করে নিতে হয়।’
‘আমি তো আমার সমস্যাটাকে স্বীকার করেছি!’ অসহায় কন্ঠে বললাম আমি।
‘হ্যাঁ। করেছেন। তবে অর্ধেক। পুরোটা করেননি!’ নিচু কন্ঠে কথাটা বলে উঠে চলে গেলেন ভদ্রলোক।
আমি পাথরের মূর্তির মত সেখানেই বসে রইলাম ।
***
আরও কয়েকদিন কেটে গেল। দিনে বা রাতে ঘর থেকে বের হইনা। আমি বসে থাকি খাটের উপর, তামান্না আমার সামনে একটা চেয়ারে বসে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। আমি মাঝে মাঝে ভাবি মেয়েটার গলা টিপে ধরলে কেমন হয়?
এমনই এক সন্ধ্যায় আমি ঘরে চুপচাপ বসে ছিলাম। তামান্না যথারীতি খাটের এক কোনে বসে কাঁদছে।
একটু আগে অকথ্য ভাষায় গালাগালি করেছি ওকে। এমন সময় আমার দরজায় নক হল।
‘ওঠো, দরজাটা খুলে দাও!’ হিসহিস করে উঠলাম আমি।
তামান্না নড়লো না।
‘তুমি দরজা খুলতে পারবে না,’ দাঁতে দাঁত চেপে বললাম আমি, ‘কারন তোমার কোন অস্তিত্ব নেই! তুমি বাস কর আমার মগজে!’
তামান্না এবারও কিছু বলল না। ফোঁপানি বেড়ে গেল শুধু।
আবার নক হল দরজায়। আমি উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলাম।
দরজার ওপাশে ধানমন্ডি পার্কে দেখা হওয়া সেই রিটায়ার্ড সাইকিয়াট্রিস্ট ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন।
আমি কোন কথা না বলে দরজা থেকে সরে দাঁড়ালাম।
ভদ্রলোকও কিছু না বলে ভেতরে ঢুকে চেয়ারটায় বসে পড়লেন।
খাট খালি। চলে গেছে তামান্না।
‘আপনার সমস্যাটা আমি ধরতে পেরেছি।’ নিচু কন্ঠে বললেন ভদ্রলোক।
‘আমার সমস্যা আমি নিজেই ধরতে পেরেছি।’ ঠান্ডা গলায় বললাম আমি।
‘হুম, জানি। সে জন্যই আমি এসেছি।’
আমি কিছু বললাম না। ভদ্রলোকের দিকে তাকাচ্ছি না, জোর করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছি।
‘আপনার ঘরে কোন আয়না আছে?’ হঠাৎ করেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন তিনি।
‘না।’ উত্তর দিতে গিয়ে গলাটা কেঁপে গেল আমার।
বাথরুমে?
‘ছিল। ভেঙে গেছে।’
‘হুম। নতুন করে লাগানো হয়নি?’
‘না।’
‘কেন?’
‘প্রয়োজন পরে না। শেভ করি না, চুল আঁচরাই না।’
‘উঁহু। মিথ্যা কথা। আপনি ঘরে আয়না রাখেন না তার কারণ হচ্ছে আপনি আয়না দেখতে ভয় পান।’ ভদ্রলোকের কন্ঠ হিমশীতল।
‘আয়না দেখতে ভয় পাব কেন আমি?’ প্রায় ফিসফিস করে বললাম আমি।
‘কারনটা আপনিও এখন জানেন। জানেন না?’
‘না…আমি জানি না!’
‘আপনি জানেন। আপনার অবচেতন মন সেটা জানে। কিন্তু আপনার সচেতন মন সেটা মেনে নিতে পারছে না। আর সেজন্যই আমাকে আসতে হল।’
‘আমি কিছু জানি না!’
‘আপনি আয়না দেখতে ভয় পান কারণ প্রত্যেকবার আয়নাতে চোখ পড়লেই আপনি নিজেকে দেখতে পান। সত্যিকারের নিজেকে দেখতে পান। নিজের সত্যিকারের চেহারাটা দেখতে পান। নিজের সত্যিকারের পরিচয়টা জানতে পারেন! সত্যটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে আপনার, যে সত্যটা আপনি মেনে নিতে পারেন না!’
মৃদু কাঁপুনি বয়ে গেল আমার শরীর জুড়ে।
‘সত্যটা কী?’ প্রায় ফিসফিস করে বললাম আমি, নিজের কন্ঠস্বরই অচেনা লাগছে নিজের কাছেই।
সত্যটা হচ্ছে আপনি কোন ইলেট্রনিক্স পন্যের দোকানের কোন তরুন সেলসম্যান নন। আপনি হচ্ছেন সেই মধ্যবয়সী নিঃসঙ্গ মানুষটা, যিনি তামান্না নামের সেলসগার্ল তরুণীটিকে দেখার জন্য প্রতিদিন শোরুমের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতেন। তামান্নার প্রতি আপনার মনে প্রচন্ড মোহ তৈরি হয়েছিল, সৃষ্টি হয়েছিল প্রবল ঘোরের। কিন্তু ওকে পাওয়ার কোন সম্ভাবনাই আপনার ছিল না। অথচ আপনি চাইতেন ওর সাথে সারাক্ষন থাকতে, কথা বলতে। যেমনটা ওই সেলসম্যান তরুণটা করে থাকে। আপনার এই আগ্রহ বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে চলে গেল যে নিজেকে ওই জায়গায় কল্পনা করতে শুরু করলেন। তারপর সেটা বাড়তে বাড়তে এমন পর্যায়ে চলে গেল যে কল্পনা এবং বাস্তবতা মিলেমিশে এক হয়ে গেল। একটা সময় এসে কল্পনাটাই সামনে চলে এসে বাস্তবতাকে আড়াল করে দিল। তারপর তামান্নার একদিন বিয়ে হয়ে গেল, চাকরি ছেড়ে চলে গেল সে। কিন্তু আপনি সেই ঘোর থেকে আর বের হতে পারলেন না! আপনি নিজেকে সেই তরুণ সেলসম্যান হিসেবে কল্পনা অব্যহত। আপনার চাকরি চলে গেল শোরুমে, বাস্তবে আপনি আপনার অফিসের চাকরি ছেড়ে দিলেন। আপনি নিজের এলাকা ছেড়ে নতুন এলাকায় এসে বাসা নিলেন, যাতে পরিচিত কেউ আপনাকে চিনতে না পারে। আপনি প্রাণপণে সেই তরুণ হতে চেয়েছেন, হ্যাঁ, অবশ্যই অবচেতন মনে। কিন্তু বাধ সাধল ছোট্ট একটা জিনিস। আয়না! শুধুমাত্র আয়নাতে চোখ পড়লেই নিজের সত্যিকারের চেহারাটা দেখতে পান। খুব চেনা একটা মুখ, কিন্তু আপনি তো এই মুখ চিনতে চান না! কাজেই আপনি আয়না দেখা বন্ধ করলেন। সব আয়না ফেলে দিলেন। সেলুনে গেলে আয়না দেখতে হবে বলে বন্ধ করলেন চুল দাড়ি কাটাও। অবশ্যই সবই আপনি অবচেতন মনে করেছেন। কিন্তু তারপরও আপনার মনে একটা ‘কিন্তু’ থেকেই যায়। এর কারন হচ্ছে সাইকোলজি নিয়ে আপনার মোটামুটি পড়াশোনা থাকা। সাধারণ কেউ হলে, ভুলেও নিজে থেকে রোগটা ধরতে পারত না। কিন্তু আপনি পেরেছেন!’
কথা শেষ করলেন ভদ্রলোক। আমি নিঃশ্বাস বন্ধ করে সব শুনে গেলাম। কতক্ষন কেটে গেল জানি না, শুধু জানি, আমি কিছুক্ষন আগেও যে মানুষটা ছিলাম, এখন আর সে মানুষটা নেই! যখন মুখ খুললাম, নিজের কানেই নিজের কন্ঠ অচেনা লাগল।
‘আমার কি করা উচিত এখন?’ ফিসফিস করে বললাম আমি।
‘আমি যেমন জানি, তেমনি আপনি নিজেও জানেন আপনার কী করা উচিত এখন।’
উঠে দাঁড়ালেন ভদ্রলোক, দরজার দিকে পা বাড়ালেন।
‘আপনার সাথে তো আর দেখা হবে না’ নিচুকন্ঠে বললাম আমি।
‘নাহ। কেন দেখা হবে না সেটাও তো আপনি জানেন। জানেন না?’ করুন ভঙ্গিতে হাসলেন ভদ্রলোক।
‘আপনি আমার ঠিকানা জানতেন না। তারপরও আমার বাসায় চলে এসেছেন।’ প্রায় ফিসফিস করে বললাম আমি।
কোন কথা বললেন না ভদ্রলোক। চোখে একরাশ বিষন্নতা নিয়ে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে।
‘আপনার সাথে আমার একবারই কথা হয়েছিল। আমি আপনাকে আমার ঠিকানা দেইনি। এমন কি কোন এলাকায় থাকি সেটাও বলিনি। তারপরও আপনি ঠিকানা খুঁজে বের করে আমার বাসায় চলে এসেছেন! এর মানে হচ্ছে, আপনিও..’
‘হ্যাঁ,’ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন ভদ্রলোক, ‘আপনার একজন ডাক্তারের দরকার ছিল, একজন সাইকিয়াট্রিস্টের। আপনার সাইকোলজির উপর আগ্রহ আছে, প্রচুর বইপত্র পড়েছেন। মিসির আলী বিষয়ক বইগুলোও পড়েছেন। পড়ার পর আপনার মনে হয়েছে এমন একজনকেই আপনি খুঁজছিলেন। কাজেই আপনার মস্তিস্ক খুব সহজেই তৈরি করে ফেলল একজন সাইকিয়াট্রিস্টকে… আমাকে। ঠিক যেমনটা আপনি চেয়েছিলেন। হুবহু সে’রকম। আমি আপনার সমস্যা ধরতে পেরেছি কারণ আপনি নিজেই আপনার সমস্যা ধরতে পেরেছেন। কিন্তু নিজেকে জানানোর সাহস পাচ্ছিলেন না। চাচ্ছিলেন এমন কারও মুখ থেকে শুনতে। কাজেই…’ কথা শেষ না করেই থেমে গেলেন ভদ্রলোক।
আমি কোন কথা বলতে পারলাম না।
‘আমি যাই।’ ভদ্রলোক চলে গেলেন।
আমি আরও অনেকক্ষন বসে থাকলাম খাটের উপর। অন্ধকারের মাঝে।
অন্ধকার অসহ্য হয়ে উঠতে উঠল এক সময়। উঠে গিয়ে সুইচ টিপে বাতি জ্বেলে দিলাম। কিছুক্ষন আগেও আমার খাটের এক কোনে বসেছিল তামান্না। এখন ওখানে কেউ নেই। আমি জানি সে আর কোনদিনও ফিরে আসবে না। অজান্তেই তোশকের নিচে হাত চলে গেল আমার, শক্ত,ঠান্ডা কিছু একটার ছোয়া পেলাম। কাঁপা কাঁপা হাতে ছোট্ট আয়নাটা বের করে নিয়ে আসলাম।
হঠাৎ আমার মনে হল দরজার কাছে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে! দেখছে আমাকে। তাকালাম, একজন তরুণী দাঁড়িয়ে আছে দরজার সামনে।
‘কী চাও তুমি?’ ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম আমি। ‘
‘বাড়ি ফিরে চল বাবা!’ ডুকরে কেঁদে উঠল তরুণী, ‘তোমাকে খুঁজে পেতে অনেক কষ্ট হয়েছে!’
আমি কিছু বললাম না। হাতে ধরা আয়নাটার দিকে তাকালাম।
একটা মুখ দেখা যাচ্ছে সেখানে। মাঝবয়সী একজন মানুষের মুখ!

Facebook Comments


Tags :